সুস্মিত মিশ্র
হাসপাতালে মারাত্মক রোগযন্ত্রণায় কেটেছে জীবনের শেষ কয়েকটি মাস। কথা বলা, গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চিরতরে। তবু তাঁর গানে, কবিতায় অশেষ সমর্পণ আর শরণাগতি।বাঙালি প্রতিভা
আর মনীষার সঙ্গে যেন হাত ধরাধরি করে চলে আদি ও অকৃত্রিম দারিদ্রতা ! বাংলা সঙ্গীতজগতের অন্যতম দিকপাল তথা প্রখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার রজনীকান্ত সেনের জীবনও যেন সেই মোড়কেই মোড়া।

তিনি বাঙ্গলার ‘পঞ্চকবি’দের একজন তবুও তার পরিচয় হয়তো অনেকের কাছেই অনন্য হয়ে উঠবে না। কিন্তু যদি বলা হয়, মহানায়িকা সুচিত্রা সেন তার নাতনি সেই সুবাদে হয়তো অনেকের কাছেই তিনি অনেকটা পরিচিত হয়ে উঠবেন। অথচ, সুচিত্রা সেন বা অন্য কারো পরিচয়ে নয়- বরং স্বমহিমাতেই তিনি চির ভাস্বর, বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের আকাশের অন্যতম নক্ষত্র শ্রী রজনীকান্ত সেন।বাংলা ভাষায় যে পাঁচজন কবি কবিতার পাশাপাশি সঙ্গীত রচনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাদের বলা হয় ‘পঞ্চকবি’। রজনীকান্ত সেন সেই ‘পঞ্চকবি’দেরই একজন। অন্যরা হলেন-
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং অতুল প্রসাদ সেন।

১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জে জন্ম রজনীকান্ত সেনের।পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ও মাতা মনোমোহিনী দেবীর ৩য় সন্তান ছিলেন রজনীকান্ত। গুরুপ্রসাদ চারশো বৈষ্ণব ব্রজবুলী কবিতাসঙ্কলনকে একত্রিত করে ‘পদচিন্তামণিমালা’ নামক কীর্তন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়াও ‘অভয়াবিহার’ গীতি-কাব্যের রচয়িতা ছিলেন তিনি। মনোমোহিনী দেবী সু-গৃহিণী ছিলেন।রজনীকান্ত সেনের মা মনোমোহিনী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে কিশোর রজনীকান্তের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। এই আলোচনা-পর্যালোচনাই তাঁর ভবিষ্যত জীবনে ব্যাপক
প্রভাব পড়েছিল। মাত্র ১৫ বছর বয়সে কালীসঙ্গীত রচনার মাধ্যমে তার অপূর্ব কবিত্বশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আইন পেশার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষতঃ সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটকে অভিনয় ইত্যাদিতে গভীরভাবে মনোঃসংযোগ ঘটান।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের থেকে চার বছরের ছোট রজনীকান্ত। অর্থাৎ তিনি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও সমসাময়িক কবি তিনি।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলনে বিলাতী সব পণ্য বয়কট করে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করার প্রতি যে দুর্বার আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, সে আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের মতো রজনীকান্তও সমর্থন দেন। রজনীকান্ত রচনা করেন-
“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই;
দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।।” –
তাঁর এই গানটি গণ-আন্দোলনে প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জোয়ার সৃষ্ট করে। এর মাধ্যমেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন এবং কান্তকবি নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।আজও যা অমলিন

রজনীকান্ত সঙ্গীতের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর ঈশ্বর-ভক্তিমূলক গানগুলোর জন্যই। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর অগাধ প্রেম, বিশ্বাস ও আস্থা তাঁর গানগুলোতে প্রতিভাত হয়ে বাংলা গানকে গভীর দর্শন চিন্তায় স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। জীবনের সমস্ত আনন্দ-যন্ত্রনার মুহুর্ত গুলোতে তিনি ঈশ্বরকে স্মরণ করেছেন।কবির জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে চূড়ান্ত আর্থিক সংকটে। গলায় ক্যানসার হয়েছিল। কিন্তু তার চিকিৎসা ছিল ব্যয়বহুল। ফলে একসময় চিকিৎসা চালাতে বন্ধুবান্ধব প্রিয়জনদের দানও গ্রহণ করতে হয় তাঁকে। শেষের দিকে খেতে পারতেন না। এমনকী কথাও বলতে পারতেন না। তবে তারমধ্যেও লিখে গিয়েছেন একের পর এক গান-কবিতা।কিন্তু ১৯১০ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ৪৫ বছর বয়সে চিরদিনের জন্য থেমে যায় কান্তকবির সৃষ্টি।জীবিত থাকাকালে তিনটি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। সেগুলো হলো –
বাণী,কল্যাণী, অমৃত এছাড়াও ৫টি বই তার মৃত্যু-পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলো হচ্ছে -অভয়া,আনন্দময়ী,বিশ্রাম, সদ্ভাবকুসুম,শেষদান।

রজনীকান্তের মৃত্যুর অনেক বছর পরে সিলেটে শ্রীহট্ট মহিলা সমিতির সভা, রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। মেয়েরা রবীন্দ্রনাথকে তাঁরই গান শোনালেন, তার পর কবিকে অনুরোধ করলেন একটা গান গাইতে।
রবীন্দ্রনাথ সে দিন গেয়েছিলেন রজনীকান্তের গান, ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিনমর্ম মুছায়ে…।’


হে কবি এখন সংবাদ পরিবার আপনাকে জানায় শতকোটি প্রণাম






