সুস্মিত মিশ্র
” সে এক দুর্বিষহ সময় এসেছিল একদিন – যখন
চারিদিকে শোনা যেত করাল দুর্ভিক্ষের হাহাকার
দেখা যেত শুভদ্র শালীনতার নির্লজ্জ অবক্ষয়
ক্ষুধিত মানুষের কান্নায় ব্যথিত হয়ে উঠত আকাশ
আর স্বার্থপরতার কদর্য ইতিহাস হনন করেছিল
অবিশ্রান্তভাবে মানবিকতার সুকুমার অনুভূতিদের ”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শত্রুপক্ষ তখন একেবারে হানা দিয়েছিল সদর দরজায়। সোনার বাংলার হাতেগোনা কিছু মানুষের কদর্য লালসা আর স্বার্থপর লোভের পরিণতিতে মানুষেরই তৈরি দুর্ভিক্ষে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যুতে চারিদিকে হাহাকার,স্বজন হারানোর যন্ত্রনা। এর সাথে ১৯৪৬-এ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও স্বাধীনতা পূর্ব দেশ বিভাজনের ফলে উদ্বাস্তু আগমন সম্পর্কিত পরিস্থিতির চাপে মৃত্যু হয়েছিল মানুষের শুভবুদ্ধি ও সুকুমার বোধের। তখন প্রকৃত পক্ষে মানবসভ্যতাই এসে দাঁড়িয়েছিল এক চরম সংকটের মুখে।
সংকুল সময়খণ্ডের সেই আবর্তে বাংলা সাহিত্যের হাল ধরেছিলেন কবি দিনেশ দাস ।বামপন্থী মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে কার্ল মার্কস, ফ্রেড্রিখ এঙ্গেল, রালফ ফক্সের রচনা পাঠ করে এক নতুন ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন। এই চিন্তামানসই তাঁর কবিতাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে আমৃত্যু।

১৯১৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আদিগঙ্গার তীরে আলিপুরের চেতলা অঞ্চলে মামাবাড়ীতে দীনেশ দাসের জন্ম হয়। বাবার নাম হৃষিকেশ দাস এবং মা কাত্যায়নী দেবী। ওনারা তিন ভাই ও এক বোন। সপ্তম শ্রেণীতে পড়বার সময়ে মাত্র বারো বছর বয়স থেকে দীনেশ দাস ছড়া লিখতে শুরু করেন। পনেরো বছর বয়সে নবম শ্রেণীতে পড়বার সময়ে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৩৪ সালে দীনেশ দাসের প্রথম কবিতা ‘শ্রাবণে’ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।১৯৩৬ সালে ‘প্রথমবৃষ্টির ফোঁটা’, ‘মৌমাছি’, ‘নখ’, ‘হাই’, ‘চায়ের কাপে’ সহ নানা কবিতা একে একে লিখতে থাকেন। তখনও তার কোন কবিতা সংকলন প্রকাশিত না হওয়া সত্বেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ সংকলন গ্রন্থে ‘মৌমাছি’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করেন।

১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো ‘কাস্তে’ কবিতা। এই কবিতাটি আধুনিক বাংলা কবিতার এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় এবং তিনি প্রায় রাতারাতি মেহনতী মানুষের জীবনযন্ত্রণা প্রকাশের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। ‘কাস্তে’ কবিতায় শুক্ল পক্ষের পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদটাকে তিনি শ্রমজীবী কৃষকের ফসল কাটার ক্ষুরধার অস্ত্র কাস্তের সঙ্গে তুলনা করেন। যে চাঁদ এত কাল কাব্যজগতে প্রেম ও সৌন্দর্যের লাবণ্যময় প্রতীক ছিল তাকে তিনি খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার করে তুললেন। এমন একটি বৈপ্লবিক চিন্তার তিনিই পথিকৃৎ।
‘কাস্তে’ কবিতাটি এক সময়ে পথেঘাটে কফি হাউসের চত্বরে যুবক যুবতীদের মুখে মুখে ফিরত। আর দীনেশ দাস পরিচিতি লাভ করেন ‘কাস্তেকবি’ হিসাবে।১৯৮৫ সালের ১৩মার্চ কবি দীনেশ দাস গোপালনগরের পিতৃগৃহে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
” নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি
তুমি বুঝি খুব ভালোবাসতে ?
চাঁদের শতক আজ নহে তো
এ-যুগের চাঁদ হ’লো কাস্তে! “
হে কবি এখন সংবাদ পরিবার আপনাকে জানায় শতকোটি প্রণাম
