Select Language

[gtranslate]
১২ই পৌষ, ১৪৩১ শুক্রবার ( ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ )

।। পুলিশ ।।

মৃদুল শ্রীমানী:-বাড়িতে পুলিশ আসত আমাকে খুঁজতে। মা বলতেন, ছেলে বাড়ি নেই। আরেক দিন আসুন। পুলিশ ফিরে যাবার আগে বলে যেত, আগামীকাল আবার আসব, তাকে থাকতে বলবেন।
রাত এগারোটার আগে বাড়ি ফিরবার ফুরসৎ হত না। খাবার দেবার সময় মা বলতেন, ওরে তোকে খুঁজতে পুলিশ এসেছিল। কাল থাকিস বাবা, ওরা ফিরে ফিরে যায়। ভাল দেখায় না। আমি মায়ের কথায় কান না দিয়ে নাজিম হিকমতের কবিতা স্মরণ করতে করতে কুমড়োর ছক্কা দিয়ে রুটি কখানা খেয়ে ফেলতাম। আমাদের বাড়িতে রাতে রুটির সঙ্গে দুধ খাওয়ার নিয়ম ছিল। আমি মাকে বলতাম, আমার দুধে চিনি দেবে না। মা আগে থেকে দিয়ে ফেলত না। কিন্তু পাতে একটু এখোগুড় দিতে চাইত। আমি আপত্তি করলে মা বলতেন, এখোগুড় একটু খেতে হয়। আমি আর বাক‍্যব‍্যয় না করে খেয়ে নিতাম। মশারি টাঙাচ্ছি দেখে মা নিজের ঘরে যেতে যেতে বলত, কাল বাড়িতে থাকিস বাবা, ওরা থাকতে বলে গেছে। ওরা মানে পুলিশ।
আমায় পুলিশ খুঁজছে। খুঁজুক। আমি বাইশ বছরের ছেলেটা, পড়াশুনা কিছুই করতাম না, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতাম, আর লিটলম্যাগ করতাম। হঠাৎ করেই বাড়িতে চিঠি এল, পাবলিক সার্ভিস কমিশনে কেরানিগিরির যে পরীক্ষাটা দিয়ে ফেলেছিলাম বন্ধু প্রবাল সেনের অকথ‍্য ঝুলোঝুলিতে, সেটাই আমাকে গেঁথেছে।
প্রদীপ সেন বাড়িতে এসে আমাকে বলে গিয়েছিলেন, আমাকে নাকি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চাই। উনি পিএসসির ইউডিএ, আপার ডিভিশন অ্যাসিসট‍্যান্ট। অত‍্যন্ত ভদ্র, সৌম্য মুখের ভাব। ওঁকে হেসে বললাম, কেরানির চাকরি করতে পারব না, তাছাড়া বেতনটাও বড্ড কম। বলতে হয়, তাই বলা, ন‌ইলে বাইশ বছর বয়সে বেসিক পের সঙ্গে ডিএ এইচ আর এ এসব মিলিয়ে জুলিয়ে তবেই গ্রস পে হয়, সে সব আমি জানতাম না। প্রদীপ সেন বললেন, চারটি সেরা ছেলেকে পিএসসি বেছেছেন, আমি তাদের প্রথমে। বললেন, আপাততঃ জয়েন করো, তারপর অন‍্য ভাল পরীক্ষা দেবার সুযোগ তো আছেই।
তো সেই ভাবে চব্বিশ জুলাই, ১৯৮৯ তারিখে পিএসসি তে গিয়ে চাকরিতে যোগদান করলাম। তখনও পুলিশ ভেরিফিকেশন হয় নি। তাই পুলিশ আমার খোঁজে বাড়িতে আনাগোনা করে।
আমি সকালে উঠে টিউশন পড়াতে যাই, বলে রেখেছি যে পড়ানো ছেড়ে দেব। ওদের মনখারাপ। তারপর অফিস যাই। তারপর অফিস থেকে বেরিয়ে কলকাতার রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন হাঁটি। মানুষ দেখি। লেখালেখি নিয়ে ভাবি। ফিরি বেশি রাতে। পুলিশের জন‍্যে সময় আমার হয় না।
মায়ের ঝুলোঝুলিতে বলে দিলাম ভারত বনধের দিন ওদের আসতে বোলো। তখন দোর্দণ্ড প্রতাপ সিপিএম। সিপিএমের ভয়ে কাক‌ও হিসেব করে কা কা ডাকে। ভারত বনধে অফিস বন্ধ থাকবে। বাস ট্রাম চলবে না। ওইদিন বাড়িতে মুখ গুঁজে পড়াশুনা করব। একফাঁকে পুলিশ এসে ঘুরে যাক।
পুলিশ এল। ততক্ষণে আমি জানি, ওরা আমার পড়াশুনার কাগজপত্র দেখবে। অ্যাকাডেমিক পড়াশুনা আমার যৎসামান্য। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল হলে কী হবে, গ্রাজুয়েশনে যাচ্ছেতাই। রেজাল্ট জঘন‍্য। ওই দেখবে। আর হাতের লেখা, আবৃত্তি, বিতর্ক, ক‍্যুইজ, এসবের গাদাখানেক সার্টিফিকেট আছে বটে, ওসব দেখানোর নয়।
পুলিশ এল। দরজা খুলতেই সাদা পোশাকের পুলিশ বলল, তোমার কাকা কোথায়? বললাম, কাকা আর পাব কোথায়, বাবা তাঁর ভায়েদের মধ‍্যে সবচেয়ে ছোট। নিজের কোনো কাকা আমার নেই। তখন হুকুম হল, তাহলে দাদা কোথায়। বলা গেল, দাদা আর কোথায় পাব, ভাইবোনের মধ‍্যে আমি সবার বড়। নিজের দাদা আমার নেই।
তখন হতাশ পুলিশ জিজ্ঞেস করল, তাহলে চাকরি কে পেয়েছে?
বললাম, আমি, এই অধম।
আমার বয়স তখন বাইশ। মুখের ভাবে মনে হয় আরো কম, কাঁচা, ঠোঁটদুটি টুকটুকে, গলা টিপলে দুধ বেরোয়, এমন চেহারা।
পুলিশ আশ্চর্য হয়ে বলল, অঃ।
বললাম, ভিতরে এসে বসুন। বাবা নেমেছেন দোতলা থেকে। ধুতির উপর হাতাওয়ালা গেঞ্জি। মধ‍্যবিত্ত ভদ্রলোকের চেহারা। বাবার সঙ্গে পুলিশ গল্প শুরু করল। বাবা কথা বলতে পারেন ভাল। বাবা কথা বলেন ওজন করে, কিন্তু তাতে একটা মিঠে মোলায়েম পরত থাকে। যে শুনছে তার ভাল লাগে। বাবার ব‍্যবহারের সঙ্গে নামটা বেশ খেটে যেত বলে বয়স্ক মামাবাবুদের মুখে শুনেছি কতবার।
বাবার সঙ্গে পুলিশের গল্প হচ্ছে, হোমিওপ্যাথির উপকারিতা, উচ্ছে নিমপাতা চিরতার জলের আশ্চর্য ক্ষমতা, যোগব‍্যায়ামে রোগ আরোগ‍্য, হরিদ্বারে কিভাবে যেতে হয়, অদ্ভুত সব বিষয়ে পুলিশ শুনে চলেছে।
আমি ছটফট করছি, কতক্ষণে রেহাই পাব। চিঠি লেখার কাজ আছে। দৈনিক চিঠি লেখার অভ‍্যাস ছিল আমার। মা একপ্রস্থ চা ও মিষ্টি দিয়ে গিয়েছেন। তারপর আরেক প্রস্থ চা, ওমলেট সহযোগে। তাও পুলিশ গলাধঃকরণ করে গল্পে মেতে আছে। অস্থির হয়ে বললাম, আমার কাগজপত্র যদি দেখেন তো আমি বসছি, ন‌ইলে উপরের ঘরে চললাম।
তিনটি মোটে মার্কশিট, তার দুটির সার্টিফিকেট। আজন্মকাল বাড়িতে রাত কাটিয়েছি। হোস্টেল, মেস, এসব কিছুই নেই আমার, দুধুভাতু জীবন। বোম বা পটকা ছোঁড়ার কথাই নেই। এহেন সোজা সরল জীবন দেখে পুলিশের চোখে করুণা এল। কচি ছেলে। ফট করে চাকরি হয়ে গেছে। তাই একটু নাক উঁচু ভাব।
আর তো বলার কিছুই নেই। আমি তক্কে তক্কে আছি কখন পুলিশ ঘুষ চায়। তখন দেব আচ্ছা করে, না বাহুবল নয়, আমাদের বাড়ির ঐশ্বর্য বাক‍্যবল।
পুলিশ আমার হাবভাব বুঝে গিয়েছে। আর বুঝে গিয়েছে আমি বাবা মায়ের আদুরে ছেলে। আমাকে কিছুটি না বলে বাবাকে সদরের কাছে আড়ালে ডেকে নিয়ে পুলিশ মনে করালো, আমরা কিছু পেয়ে থাকি। বাবা, ব‍্যাঙ্কে চাকরির মধ‍্যগগনে, জীবনের সোনার হরিণ কবে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে, বাবা জানেন, পুলিশকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়। বাবা বললেন, হ‍্যাঁ আনছি।
হস্তক্ষেপ করলাম আমিই। বললাম, না। টাকাপয়সা দেওয়া হবে না।
পুলিশ বলল, সে কি! সবাই তো দেয়।
বললাম, এবাড়িতে ওসব হবে না। আপনার কাজ মিটে গেছে। আপনি আসতে পারেন।
পুলিশ বলল, আমি কিছু চাই না। আপনার ফ‍্যামিলি খুব ভাল। তবে বাইরে আরো কয়েকজন আছে। তাদের মিষ্টি খাবার জন‍্য।
আমি বললাম, না। কোনো কিছু দেওয়া হবে না।
পুলিশ বলল, তোমার কিন্তু ক্ষতি হয়ে যাবে।
বললাম, আমি সরকারি কর্মচারী। আপনিও। কাকে কি কাকের মাংস খায়!
পুলিশ মাথা নিচু করে চলে গেল।
পিএসসিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট সবচাইতে আগে পৌঁছেছিল আমার।


সৌজন্যে প্রতিলিপি

Related News

Also Read