শাশ্বতী রায় :- আজ সিঞ্জিতার পাকা দেখা। এর আগে ঋষি আর তার বাবা এসে দেখে গেছে একবার। সঙ্গে অবশ্য ঋষির মামাতো দিদিও ছিল। সিঞ্জিতাকে এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায় ঋষির। তারপর তিন সপ্তাহ ধরে ফোনে কথা চলছে। এম.সি.এ করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে সিঞ্জিতা। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। কথাবার্তাও বেশ সুন্দর। ঋষি তো একরকম প্রেমেই পড়ে গেছে এই কদিনে। সিঞ্জিতারও ভালো লেগেছে ঋষিকে। ফিজিক্সের প্রফেসর ঋষি। তবে কথাবার্তার মধ্যে এখনও ছেলেমানুষী রয়ে গেছে। সেটাই বেশি ভালো লেগেছে তার। এখন একটাই হার্ডল বাকি। ঋষির মা। প্রথম দেখার দিন কোনো বিশেষ কাজে আটকে পড়ে উনি আসতে পারেননি। আজ পাকা দেখাতে উনিই বিশেষ অতিথি। ঋষির মুখে তার মায়ের সম্পর্কে কিছু কিছু জেনেছে সিঞ্জিতা। মনে হয়েছে সামান্য মেজাজি। বাবা,মাকে আগেই এ ব্যাপারে বলে রেখেছে সে। ভদ্রমহিলা আজ সামান্য রোয়াব দেখালেই বিয়ে ভেঙে দেবে সে। ঋষির সাথে যতই মনের মিল থাকুক না কেন, বিয়ের আগেই যা বোঝাপড়া হবার হয়ে যাক। পরে অশান্তি, ডিভোর্স এসবের মধ্যে যাবার কোনো ইচ্ছে নেই তার।
বিকেল সাড়ে চারটেয় আসার কথা ছিল। স্বামী,পুত্রের সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটেতেই মেয়ের বাড়িতে পা রাখল অনুপমা। সময় দিয়ে কাউকে অপেক্ষা করানোটা কোনোদিনই সে পছন্দ করে না। তাদের দেখেই এ বাড়িতে বেশ ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। পাত্রের মা এসেছে বলে কথা। কে কিভাবে যত্ন করবে ভেবে পাচ্ছে না। সিঞ্জিতার বাবা,মা,দুই কাকা, কাকিমা সবাই উপস্থিত। ছোট ভাই,বোনেরা পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। চায়ের ট্রে হাতে সিঞ্জিতাও হাজির। নিজের সম্বন্ধ দেখার দিনগুলো মনে পড়ছিল অনুপমার। বত্রিশ বছর হতে চলল আজও কিছু বদলায়নি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে টুকটাক কথা চলছে। সিঞ্জিতার পড়াশুনা, চাকরি, পছন্দ, অপছন্দ, ইত্যাদি। খানিকক্ষণ কথা হবার পর অনুপমা সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেল
– আশীর্বাদের দিনক্ষণ কি আপনারা দেখবেন নাকি আমি আমাদের পুরোহিত মশাইকে বলব।
কথাটা শোনার পর সবারই মুখে হাসি। এতক্ষণ ঋষি সিঞ্জিতার দিকে আড়চোখে দেখছিল। এবার তার মুখেও দুষ্টু মিষ্টি হাসি। ছেলে খুশি দেখে অনুপমা আর তাপসও খুশি। ফেরার আগে হঠাৎই সিঞ্জিতার বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন প্রণাম করার জন্য। সিঞ্জিতা বাবার কথামত এগোচ্ছিল, অনুপমা বাধা দিল,
– না না প্রণাম করতে হবে না।
– সেকি কেন? আজ থেকে আপনিই তো ওর মা। আপনাকে প্রণাম না করলে হয়!
সেই এক মানসিকতা। ছোট্ট একটা শ্বাস পড়ল অনুপমার।
– শুনুন রঞ্জনবাবু, কয়েকটা কথা আমাদের সবার জেনে রাখা ভালো। আমি ওর মা নই। মা একজনই হয়। আমি শত চেষ্টা করলেও ওর মা হতে পারব না।আর সিঞ্জিতাও আমার মেয়ে হতে পারবে না।
– এভাবে বলছেন কেন? চেষ্টা করলে কি না হয়? সিঞ্জিতার মা প্রায় কাঁদো কাঁদো।
– চেষ্টা করলেও হয় না। জোর করে মা,মেয়ের মত একটা সম্পর্ক চাপিয়ে দিলে তাতে ভালোবাসা কম আর ডিউটির গন্ধ বেশি আসবে। ও আমাকে আন্টি বলে ডাকলেও আমি একটুও দুঃখ পাব না। জোর করে অন্যকে মা,বাবা ডাকা ব্যাপারটাতেও আমার ঘোর আপত্তি।
– আপনার চিন্তা ভাবনা একেবারে অন্যরকম দিদি। আমরা হয়তো একটু পুরোনোপন্থী।
রঞ্জনের গলায় উদ্বেগের সুর। হাসল অনুপমা।
-পুরোনো,নতুন কিছু হয় না। সবটাই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেনে চললে সুখ,নাহলে অসুখ। আরও একটা জরুরী কথা বলে রাখি। আর্থিকভাবে আমরা আমাদের ছেলের ওপর নির্ভর করি না। কিন্তু যেহেতু আমাদের একটাই ছেলে তাই মানসিকভাবে সবসময় ওর ওপর নির্ভর করব। বিপদে আপদে ঠিক যেভাবে আপনার মেয়ে আপনাদের পাশে থাকবে, আমাদের ছেলেও কিন্তু আমাদের পাশে থাকবে সেটাই আশা করব। এটা কিন্তু সিঞ্জিতাকে বুঝতে হবে।
– হ্যাঁ, নিশ্চয়ই এটা আবার বলার অপেক্ষা রাখে নাকি। লজ্জা পায় রঞ্জন।
– তাহলে আজ আসি আমরা!
সিঞ্জিতার দিকে ফিরল অনুপমা,
– মা,মেয়ে না হলেও অন্য একটা সম্পর্ক কিন্তু আমাদের হতেই পারে। কি বলোতো?
– কি? আধফোটা স্বরে বলল সিঞ্জিতা।
– বন্ধুত্বের। সময় নিয়ে ভেবে দেখো।
গাড়িতে বসে তাপসকে দেখছিল অনুপমা। ওই বাড়িতেও চুপ করেছিল। এখানেও চুপচাপ। কোনো কারণে রাগ হয়েছে নাকি। হোক গে। বত্রিশ বছর অনেক রাগ ভাঙিয়েছে। আর নয়।
বাড়িতে ঢুকেই ফেটে পড়ল তাপস
-কি সব বলছিলে ওদের বাড়িতে। পাগল হয়ে গেছ নাকি? এই বিয়ে যদি ভেঙে যায় তার দায় তোমার। শুধু তোমার।
কথাগুলো বলে স্টাডিতে ঢুকে গেল তাপস । থমথমে মুখে ঋষিও নিজের ঘরে চলে গেল।
ড্রইংরুমে একা বসে নিজেকে খুঁড়ছিল অনুপমা। সে কি আজ একটু বেশি বলে ফেলল। কিন্তু কথাগুলো তো বর্ণে বর্ণে সত্যি। তার বিয়ের আগে ঠিক এরকমই করছিল বাবা। তাপসের বাড়ির লোকদের মাথায় তুলতে তুলতে নিজেই ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিল। তাতে কি লাভ হয়েছে। প্রাপ্য সম্মান পেয়েছে কোনদিন মেয়ের বাড়িতে? সে নিজেই বা কি পেয়েছে? ঋষি বড় হবার পর তাপসের তেজ একটু কমেছে। বিয়ের পরের কয়েকটা বছর তো ভোলার নয়। নেহাত অনুপমার চাকরির জোরটা ছিল বলে কোনদিন সেভাবে এঁটে উঠতে পারেনি তাপস । সেই শোধ তুলত তার বাপের বাড়ির কেউ এলে। বরাবর স্ত্রীর বাবা,মাকে হেলা তুচ্ছ করেছে অথচ নিজের বাবা,মায়ের জন্য কর্তব্যে সামান্য ত্রুটি হলেই চিৎকার করে সারা পাড়াকে জানিয়েছে।
মনে পড়ে শাশুড়ির শেষ সময় তার মল, মূত্র পরিষ্কার করতে হয়েছে অনেকবার। তাতে কি ওনার জন্য ভালোবাসা বা উদ্বেগ কোনোটাই ছিল? নাকি বমি চেপে শুধু কর্তব্যটুকুই পালন করেছিল সে। তার থেকে আজ সত্যি কথাটা সহজভাবে বলে এসেছে। কিন্তু মেয়েটা যদি মুখরা শাশুড়ি ভেবে বিয়ে ভেঙে দেয়! ঋষি কি কষ্ট পাবে? কদিনের তো আলাপ। ভালোবেসে ফেলেছে কি মেয়েটাকে। কেন যে এত কথা বলতে গেল সে। কি করবে, নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আজ এমনভাবে চোখের সামনে ভেসে উঠল। নিজেকে সামলাতেই পারল না।
ডিনারের পর সিঞ্জিতাকে ফোন করাটা অভ্যাস হয়ে গেছিল ঋষির। কিন্তু আজ ফোনের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও থমকে গেল। কি জানি রেগে আছে কিনা। মায়ের কথার জন্য হয়তো ওই বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে। ইশ, কেন যে মা পাকা কথা বলতে গেল। দুশ্চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুম এসে গেছিল ঋষির। ফোনের সুরেলা ধ্বনিতে চমকে উঠল। সিঞ্জিতার ফোন। তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করল সে।
– হ্যালো..
– আজকে ফোন করলে না যে?
– আমি ভাবলাম তুমি হয়তো রাগ করেছ।
– রাগ করবো কেন?
– না মানে মা এত কিছু বলল।
– ঠিকই তো বলেছেন উনি। সত্যি কথাগুলোকে সহজভাবে বলেছেন। যেগুলো আমাদের মনে থাকলেও আমরা বলতে ভয় পাই।
– তুমি সত্যি রাগ করোনি তাহলে?
– একদম না। বরং মনে হচ্ছে তোমার থেকে বেশি তোমার মায়ের প্রেমে পড়ে গেছি।
– আমারও প্রেমে পড়েছ তাহলে?
– ধ্যাত, বয়েই গেছে আমার।