Select Language

[gtranslate]
১২ই পৌষ, ১৪৩১ শুক্রবার ( ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ )

।। পরশমনি ।।

সুনন্দা মিত্র :-নতুন বৌকে বরণ করতে গিয়ে দু ‘পা পিছিয়ে এলেন মঞ্জুলিকা । মেয়েটি ভারী সুন্দরী ; সৰ্ব্বাঙ্গ দিয়ে রূপের জেল্লা ফুটে বেরিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে । মৌলি —নামটিও ভারী মিষ্টি। একমাত্র ছেলে দেবমাল্যর প্রেম করে পছন্দ করা । প্রথম ভিডিওতে দেখেছিলেন । দেবমাল্য বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করছে ; পড়াশুনো ছাড়া কিছুই বোঝে না । তবু মৌলির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই প্রেম ও তারপর বিবাহ ।


মঞ্জুলিকার অনুপস্থিতিতে বিদেশেই বিয়েটা হয়েছে , উনি আপত্তি করেন নি । একে কোরোনার অস্থির সময় ,তার মধ্যে দেশে ফিরে ধুমধাম করার মতো মানসিকতা এখন নেই । মৌলি ও তার বাপ্ মাও আমেরিকায় প্রবাসী ; কাজে কাজেই ছেলের যখন পছন্দ হয়েছে তখন ভালোয় ভালোয় বিয়েটা মিটে গেলেই ভালো । এখনকার ছেলে তো , কখন আবার মত পাল্টে বিয়ে করবো না বলে বসে তার কোনো স্থিরতা নেই । এতো বছর বলে বলে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রায় । এখন হঠাৎ এই সুখবর ; ছেলে যখন বিদেশেই স্থিতু হবে তখন আর নিজের পছন্দই প্রথম এবং শেষ । দৈবাৎ ছুটিছাটায় বাড়ি ফিরলে তখন যেটুকু দেখাশোনা হবে —-তবে সে আর কতটুকু !


ছেলে দেবমাল্যকে একরকম খরচের খাতাতেই লিখে রেখেছেন মঞ্জুলিকা । সেই ছোটবেলায় ওর বাবা দেবোত্তম মারা যাবার পর থেকেই কলেজে প্রফেসরি করতে করতে এক অন্য জগতের সন্ধান পেয়ে গেছেন তিনি । তাই ছেলেকে স্বাধীন করে দিতে তার বাধে নি । বন্ধন কাটাতে পারলে তবেই মুক্ত আকাশের সন্ধান মেলে । মঞ্জুলিকা জ্ঞানের জগতে তার খোলা আকাশের ঠিকানা পেয়েছেন । তাই ছেলে দেবমাল্য ও তার নতুন বৌ মৌলির সন্মন্ধে তার মনে কোনো প্রত্যাশা ছিল না । দূরে থাকবে থাকুক ; ভালো থাকুক ওরা , নিজের মনে ,নিজের মতো করে —এটাই ভেবে ছিলেন ।
তবু মেয়েটির সামনে গিয়ে নিজের একটা সাবেকী নেকলেস উপহার দিয়ে ,দুটো কথা বলে একটু মিষ্টিমুখ করাতে গিয়ে প্রথম ধাক্কাটা খেলেন ।


—‘এইসব হাই ক্যালোরি মিষ্টি খেয়ে কি ফিগারের বারোটা বাজাবো নাকি ? আমি ফ্রুট কাস্টার্ড ,ফ্লেভার্ড ইয়োগার্ট ছাড়া কিছু খাই না ‘—ফুঁসে উঠে হিমশীতল গলায় কাটা কাটা উত্তর দিলো মৌলি ।


ওহ ! যেমন সুন্দর ,তেমন ই ঠান্ডা সরীসৃপের মতো চাউনি ; এতো ছেলেমেয়ে পড়িয়েছেন তবু কেমন ধাক্কা খেলেন তিনি । এরকম একটা কঠিন হৃদয় মেয়ের সঙ্গে জীবন কাটাতে পারবে তো দেবমাল্য ? অবশ্য সে তার বাবার মতোই ভুলোভালা স্বভাবের ; ফিজিক্স আর ম্যাথমেটিক্স ছাড়া তার জীবনে আর কিছু নেই । মনে হয় এসব ব্যাপার তার চোখ এড়িয়ে যাবে । সবসময় তো কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে ,ঘরে -বাইরে । এই সংক্ষিপ্ত ছুটিতে বিয়ে করে ,দেশে ঘুরে ,হনিমুন সেরে ফের ফিরে যেতে হবে ।
কালকেই ফ্লাইট —-সোজা শ্রীনগর । তারপর কদিন ঘুরে ফের কলকাতা ছুঁয়ে আবার আমেরিকার কর্মজীবনে ফেরত যাবার পালা । দু ‘জনের মনোজগৎটা পুরোটাই আলাদা । একজন থাকবে রিসার্চ আর পড়ানো নিয়ে ,আরেকজন নিজের রূপচর্চ্চা আর ফিগার নিয়ে । চোখের সামনে থাকলেও আসল দূরত্বটা চোখে পড়বে না ; অন্ততঃ সেরকমই আশা করা ভালো ।

মায়ের আশামতো কাজ হলো না অবশ্য । খুব দ্রুততায় সময় কাটলেও ব্যাপারটা চোখে পড়ে গেলো দেবমাল্যর ; বেশ স্পষ্ট ভাবেই , আরো দিন দুয়েকের পর ।
কলকাতায় নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত রিসেপশন ,পার্টি আর লোক- লৌকিকতা সেরে খুব দ্রুত শ্রীনগরের ফ্লাইট ধরে , এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে একটা দামী হোটেলে চেক- ইন করলো দু ‘জনে । ল্যাপটপে ট্যুর প্ল্যান করে ,গাড়ি বুকিং করে ,পরদিন বেরিয়ে পড়লো দেবমাল্য ,সস্ত্রীক ;সাইট সীইং করতে —কিন্তু নামকরা বহুল প্রচারিত টুরিস্ট স্পটগুলো বাদ দিয়ে অনামী পাহাড় ,উপত্যকা ,নদী ,গ্রাম ,এইসব ঘুরে দেখবে বলে।


ড্রাইভার ইউসুফ ছেলেটি ভারী নম্র আর সরল , ওর স্বচ্ছ ছাউনিতে একটা চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মিষ্টত্বের মিশেল আছে মনে হয় । তাছাড়া বি এম ডাব্লিউ গাড়িটা চালাচ্ছে যেন পালকের মতো মসৃন ভাবে ; পাহাড়ি রাস্তা বলে মনেই হচ্ছে না । ইউসুফ সহজেই দেবমাল্যর পচ্ছন্দ বুঝে নিয়ে নাম – না -জানা ,টুরিস্ট ম্যাপের বিশেষ গন্তব্যগুলো এড়িয়ে অপূর্ব্ব সব অন্যরকম এলাকা দিয়ে নিয়ে চলেছে ওদের গাড়ি । অতএব সেখানে তেমন কোনো দোকানপাট ,ক্যাফে ,ফুড জয়েন্ট ও নেই । মাঝে মাঝে উপত্যকার উপর বয়ে যাওয়া উপলকীর্ণ পাহাড়ি নদী ; দূরে নাম -না – জানা ফুলে ছাওয়া বনস্পতি আর মাঝে মাঝে দু ‘একটা গ্রামের মানুষ চোখে পড়ছে ,সঙ্গে ঘোড়া ।

দেবমাল্য উত্তেজিত হয়ে সামনের সিটে ইউসুফের পাশে চলে এসেছে ; ছবি তোলার সুবিধার জন্য। সামনের জানলার মধ্যে দিয়ে দেখা দৃশ্যের প্রসারতা অনেক বেশী ।পিছনের সিটে মৌলি নিজের ছোট্ট আয়নায় পরিপাটি প্রসাধন করতে ব্যস্ত । তাড়াতাড়ি করে বেরোতে গিয়ে মেক -আপ টা ঠিকমতো করবার সময় হয় নি ।বাইরের দৃশ্য দেখে দেবমাল্য সমানে গাড়ি থামাতে বলছে ,ফটো তুলছে —-হঠাৎ একটা ভালো ভিউপয়েন্ট দেখে ছুটে নেমে বেরিয়ে গেলো ,পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ক্রমে নীচে নামতে লাগলো ; বোধহয় নীচের উপত্যকায় যেতে চায় , যেখানে নদী বইছে।


ভালো পাগলের পাল্লায় পড়া গেলো —মনে মনে ভাবছিলো মৌলি । তবে এসব ছেলেদের বশ করা খুব সহজ ; নিজেদের নাওয়া খাওয়া ,টাকাকড়ির দিকে বিশেষ খেয়াল থাকে না ; সর্ব্বদাই মুক্তহস্ত । খালি এদের মনের স্টিয়ারিংটা হাতে ধরে রাখতে হয় আর এদের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে নিজের কাজ হাসিল করে নিতে হয় । ভালোই বর হয়েছে মৌলির ; এতদিনের ডেটিংয়ের সুবাদে জানা ঘোর কেপ্পন ,হিসেবী,বর্ব্বর জাতীয় বর নয় ।


তবে আপাততঃ সমস্যা হলো কিছু স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার হলে ভালো হয় । কাছেই একটা কটেজ দেখা যাচ্ছে ,রাস্তার অন্যদিকে ; বোধ হয় কোনো খাবার বিক্রী করে ,বাইরের সাইনবোর্ড দেখে তাই মনে হচ্ছে । এতো দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ভালো করে । ওই ইউসুফটাকেই কাজে লাগানো যাক ।


ইউসুফ ইতিমধ্যে স্মার্ট ফোন খুলে মগ্ন হয়ে পড়েছে । কয়েক বার পিঠের উপর খোঁচা মেরে ওর চটকা ভাঙ্গালো মৌলি । তারপর বেশ অভদ্র ও রূঢ় স্বরে ওকে কিছু আনতে হুকুম দিলো ।

বাংগালী বিবিলোগ ইতনা বেশরীফ (বাঙালি মহিলারা এতটাই অভদ্র )—-মনে মনে বিরক্ত হয়ে নেমে গেলো ইউসুফ। বেশ অপমানিত লাগছে নিজেকে ; তবে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যেন মাথাটা ঠান্ডা লাগলো —-মাথায় থাক আত্মসম্মান ; খাবার খুঁজতে গেলে তো কিছুক্ষন ওই অভদ্র মহিলাটার কাছ থেকে দূরে যেতে হবে —সেটাই লাভ।


তিতিবিরক্ত হয়ে বেখেয়ালে চাবিটা গাড়িতে লাগানো অবস্থায় নেমে গেলো ইউসুফ ,যদিও স্বয়ং মেমসাব গাড়িতে বসে আছেন । আর তখনি ,ইউসুফ নেমে আট দশ গজ এগোতেই আচম্বিতে ঘটলো ঘটনাটা ।একটা চলন্ত গাড়ি ফুল স্পিডে আসতে আসতে রাস্তায় টায়ার পাঙ্কচার করলো ; গাড়িটার দরজা খুলে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে নেমে এলো দুজন মুখোশধারী উগ্রপন্থী ; হাতে অত্যাধুনিক রাইফেল। সোজা মৌলির গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলো ওরা । একজন গাড়ি চালাতে লাগলো ,আর অন্যজন পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে পিছনের সিটে বসা মৌলির কপালে লাগিয়ে বললো —-‘সিট্ সে উতার কে নিচে বৈঠ না ,নহি তো খোপড়ী উড়া দেগা ‘ (সিট্ থেকে নেমে নিচে বোস ,নয়তো খুলি উড়িয়ে দেব )।


কাঁপতে কাঁপতে নীচে নেমে বসলো মৌলি । একবার কাঁপা হাতে মোবাইলটা অন করতে গেলো ; মুহুর্ত্তে সামনের খুনিটা ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে পাশের খাদে ফেলে দিলো মৌলির হ্যান্ডব্যাগ । কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে কিছু একটা বললো ; মাথা ঘুরে গাড়ির পিছনের সীটের তলায় তলিয়ে গেলো মৌলি ।

এক মূহুর্ত্তের মধ্যে এক চূড়ান্ত বিভীষিকার মধ্যে পড়ে গেলো মৌলি । গাড়ি চালানো লোকটার নাম সুলেমান ; হাতে রিভলবার টা রহমান। ওদের গাড়ি চলেছে নক্ষত্রবেগে —কোথায় ,কোনদিকে বুঝতে পারছে না মৌলি । নিচে দলা পাকিয়ে বসে বসে গা হাত পা ব্যাথা করছে ,কেন যে কাশ্মীর কাশ্মীর করে জেদ ধরেছিলো ; এতবার দেবমাল্য বারণ করা সত্বেও ।কেন যে ইউসুফকে জোর করে গাড়ি থেকে নামিয়েছিল খাবার খুঁজতে ,কেন যে ওকে বিশ্রী ভাবে কথা বলে ওর ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিয়েছিল !! সবটাই ওর নিজের জেদ আর দুর্ব্যবহারের ফল ; আর কারোর নয় ।


কিরকম মাথা ঘুরছে ,যন্ত্রনা হচ্ছে কপালে ,গা গুলিয়ে বমি পাচ্ছে জোর। একবার সুযোগমতো মাথা উঁচিয়ে ,জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মারবার চেষ্টা করেছিল ; সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভিং করা অবস্থায় সুলেমান গর্জ্জন করে উঠলো —-রহমানের রিভলবারের নল কপালে ঠেকলো । সুলেমান খতম করে দিতে বললো ওকে ; সেকী ভয়ংকর দৃষ্টি , মুখোশের ফাঁকে চোখ দুটো ধারালো ছুরির ফলার মতো জ্বলছে। এক ঝলক ঘাড় ফেরাতেই সে দৃষ্টি আমূল বিঁধে গেলো মৌলির মনে । এ একটা দাগী খুনি না হয়ে যায় না –একটা সিরিয়াল কিলার ; মানুষের যে এতো ভীষণ চেহারা হতে পারে ভাবা যায় না ,এতো নৃশংসতা মুখের প্রতিটি রেখায় । তুলনায় রহমান আর একটু ভালো —ও গালাগালি দিলো কিন্তু ট্রিগার টিপলো না ।


—-‘সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার ওটা ‘– সুলেমান খিঁচিয়েউঠলো ; বললো —‘খতম করে দে ,নইলে সাক্ষি থেকে যাবে । ‘


রহমান বললো —-‘ আমরা তো সবার সামনেই খুন করে জেল থেকে পালালাম ; সবাই জানে আমাদের নাম ,এ আর নতুন কি সাক্ষি দেবে ?’


ভয়েতে গা গুলোতে লাগলো মৌলির ; প্রানপনে নিজেকে স্থির রাখবার চেষ্টা করতে লাগলো ও । শীতের দিন ; দিনের আলো দ্রুত নিভে আসছে —এবার বমি করবার জন্য ওয়াক তুললো ও । গাড়িটা ব্রেক দিয়ে দরজা খুলে ওর ঘাড় ধরে তুলে পিছনে একটা লাথি মেরে রাস্তার ধারে ফেলে দিলো রহমান আর এক দলা থুতু ফেলে গাড়ির দরজা বন্ধ করে সবেগে বেরিয়ে গেলো ওরা দুজন ।


মাথাটা জোরে পাথরে ঠুকে ব্যাথা করতে লাগলো আর সেইসাথে পিত্তি বমি ; তার সাথে গত রাতের ডিনারের কিছু অবশেষ । সারা শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রনা ; মাথা ব্যাথা করছে খুব ,ভয়েতে সারা শরীর কাঁপছে । জেল পালানো খুনি দুটো আবার ফিরে আসবে না তো !


দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে । রাস্তার একপাশে খাদ ; অন্যপাশে পাহাড় খাড়া উঠে গেছে ,সেখানে গভীর জঙ্গল । প্রাণভয়ে লতাপাতা আঁকড়ে ,পাথরে হামাগুড়ি দিয়ে উপরে বেয়ে উঠে গাছের তলার ঝোপের উপর একটা বড়ো চ্যাটালো পাথরের উপর বসে গা ঢাকা দিলো মৌলি । স্টিলেটো হিলটা আর কাজে লাগবে না । ওটা পাশে ঝোপে লুকিয়ে রেখে ,খালি পায়ে ,ভয়ে ,আতঙ্কে ,অসহায় ভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো মৌলি ; নিঃশব্দে ।

বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিল ভয়ে ,কে জানে ; মনে হলো একটা নরম ,গরম জিভ দিয়ে একটা লোমশ মুখ ওর গাল চেটে দিচ্ছে । কোনোরকমে চোখ খুলে দেখলো ভালুক নয় ,একটা বিশাল লোমওয়ালা পাহাড়ি কুকুর।


কুকুরটার চোখ দুটো বন্ধুত্বপূর্ণ ; ভারী বুদ্ধিদীপ্ত আর ঝলমলে ,ভালোবাসায় জ্বলজ্বল করছে । ও লেজ নাড়ছে মৃদু মৃদু ,কেউ ওর নাম ধরে ডাকছে —-‘শেরু ,শে -এ-এ-রু ,শে -এ -এ -রু । শেরু এবার উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করলো ; পিছন ফিরে ফিরে যেন ওকে ডাকলো আর মৌলি কোনোরকমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে অনুসরণ করতে লাগলো শেরুর । কিছুটা উপরে ,নিচে চলে দেখা গেলো একটা ভেড়ার পাল আর একটি ছোট বছর দশেকের গ্রাম্য ছেলে যে সমানে শেরুকে ডেকে চলেছে ।


ছেলেটি মৌলিক দেখে অবাক হয়ে ওদের ভাষায় কি বললো ,ঠিক বুঝলো না মৌলি । তবে ছেলেটি ,শেরু ও ভেড়ার পালের সঙ্গে চলতে চলতে ও পৌঁছে গেলো একটা সবুজ উপত্যকার উপর একটা পাথরের কুঁড়ে ঘরে । —-‘শাহিদা ,শাহিদা ‘-বলে ডাকলো ছেলেটি ।


একটা সুন্দর বছর চোদ্দ -পনেরোর মেয়ে দরজা খুলে দিলো । ছেলেটি উত্তেজিত হয়ে দিদিকে অনেক কিছু বলতে লাগলো । বোধহয় উর্দু মিশ্রিত হিন্দি —কে জানে ! মৌলি বুঝলো ছেলেটির নাম আনোয়ার ; ওরা দু ‘ভাইবোন ,শেরু ওদের কুকুর । ওরা মেষপালক । ওদের ঘরে আশ্রয় হল মৌলির ।
ঘরটি মাঝারি মাপের । এক কোনে খাটের উপর শুয়ে ওদের দাদী মা ; অসুস্থ । মা বোধহয় নেই । বাবাকেও দেখতে পেলো না মৌলি । ওরা কাঠের আগুনে গরম রুটি বানিয়ে রাজমার ডাল দিয়ে ওকে খাওয়ালো আর ওদের খাটে লেপের তলায় শুইয়ে দিলো । মোটামুটি বোঝা গেলো কাল সকালে শাহিদা অন্যদের বলে মৌলিক ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করবে ।


প্রানে যে বেঁচে আছে তাতেই আশ্চর্য্য লাগছিলো মৌলির । কোথায় পড়ে রইলো তার ফেলে আসা সভ্য জগতের পরিচয় ,তার চিন্তাভাবনা ,তার অহঙ্কার । এই বিশাল প্রকৃতির কোলে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা ভরা মানুষদের মধ্যে তাদের যৎসামান্য উপকরণের আপ্যায়ন ওর আত্মকেন্দ্রিক বোধের বাইরে । অর্থ দিয়ে এর মূল্য হয় না ,এদের ঋণ শোধ করা কোনোদিন ই সম্ভব নয় ।


পাথরের দেওয়ালের উপরে বসানো পাথরের চালার মধ্যের ফাঁক দিয়ে পাহাড়ের নৈশ হাওয়া বয়ে যাচ্ছে হাড় কাঁপিয়ে।


কাঠকয়লার আগুন জ্বালানো ছোট ছোট লোহার উনুনের আঁচের লালচে আলোর আভা দেওয়ালে আলোর আল্পনা আঁকছে । গাছের পাতায় পাতায় শিরশিরানি হাওয়ার আওয়াজ ,নদীর বয়ে যাওয়া অবিরাম কুলকুল ধ্বনি , রাতের জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাওয়া রাতচরা পাখির ডাক , এক অচেনা ,অজানা মানুষদের দরিদ্র পরিবারের অনাবিল ভালোবাসা ,কেমন আচ্ছন্ন করে তুলছে আজন্ম স্বার্থপরতায় লালিত মৌলির মন । নিজেদের খাট ছেড়ে দিয়ে ওরা শুয়ে আছে মেঝের একপাশে জড়ো করে রাখা খড়ের গাদায় ! নিজেকে যেন খুব ছোট মনে হচ্ছে এখন।


কখন ঘুম এসেছিলো টের পায় নি মৌলি ।অনেক অজানা পাখির মিষ্টি সম্মিলিত গানের সুরে ঘোর কাটলো মৌলির ।শাহিদা এর মধ্যেই উঠে বাইরে থেকে ঝর্ণার জল আনতে যাচ্ছে ; মাথায় কলসি । চট করে উঠে মৌলি চললো ওর সাথে সাথে । কথা ছাড়াই ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় হচ্ছে এখন । নদীর জলে হাতমুখ ধুয়ে ঝর্ণার জল কলসিতে ভরে ফিরে এলো দু ‘জন্যে । এবার গরু -ভেড়া -হাঁস -মুরগিদের খেতে দেওয়ার পালা । শেরু আর আনোয়ার নাস্তা -পানি খেয়ে ভেড়ার পাল চরাতে বেরিয়ে গেলো । ওদের বাবা ঘোড়াওয়ালা , শহরে কাজে গেছে ; ক’দিন পরে পরে বাড়ি আসে।


সব কথা ওদের পড়শী সলমনের কাছ থেকে জানতে পেরেছে মৌলি । সলমন কিছুটা হিন্দি জানে । তার বয়স বারো -তেরো হবে । এই এলাকায় মানুষ খুব গরিব । দু ‘একজন শহরে গরম শালের উপর হাতের কাজ বিক্রী করতে যায় । শ্রীনগর এখন থেকে দুই -তিন দিনের পথ ; ঘোড়াতে । সেখানে মোবাইল চলে ,আশেপাশের এলাকাতেও । গ্রামের ঠিক এই এলাকাতে মোবাইলের টাওয়ার ধরে না ,বেশ কিছুটা দূরে গেলে,কয়েকটা পাহাড়ের বাঁক পেরিয়ে , তবে পাওয়া যায় । তবে ,মৌলির মোবাইল তো কোথায় কোন খাদের অতলে তলিয়ে গেছে ,এখন এ প্রশ্ন অবান্তর ।


শাহিদা – আনোয়ারের বাবা শহরে কাজের জন্য চলে যায় ; ওদের মা নেই ,ছোটবেলায় মারা গেছেন ।দিদাকে দেখাশোনা , রান্না ঘরের কাজ ,সব শাহিদা করে । আজ সকালে শহর থেকে আসা একজন পড়শীর কাছে জানা গেছে যে ওখানে জেল পালানো উগ্রপন্থীদের গুলিতে ক ‘জন সিকিউরিটি মারা গেছেন ,ধরা পড়েছে ক ‘জন ; জেলের একটা গাড়ি করে পালিয়ে গেছে দু ‘জন । এখন দু -তিনদিনের কারফিউ ও বন্ধ চলেছে ।


পাশের গ্রামের পাহাড়ে নৌসাদ চাচা কলকাতায় শাল ফিরি করতে যান । তাকে খবর দিয়ে নিয়ে আসবে সলমন ; তাহলে মৌলির আর কোনো অসুবিধা হবে না । দুপুরের মধ্যেই আশেপাশের পাড়া -পড়শিদের ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে মৌলির সাথে দেখা করতে আসে ।এখানে কারফিউয়ের কড়াকড়ি নেই । অনেক দূরে দূরে পাহাড়ের কোলে একটি -দুটি ছোট পাথরের কুঁড়ে ঘর ।


অতিথির জন্য ওরা কেউ নিয়ে এসেছে গাছের ফল ,কেউ বা বাড়ির কোনো বিশেষ রান্নার পদ । পরদিন দুপুরে নদীর ধারে দস্তরখান পেতে ওদের সম্মিলিত খাওয়া দাওয়া হলো । একজন দুজন করে সারাদিন পড়শিরা দেখা করে গেলো মৌলির সঙ্গে । কেউ কেউ ওদের হাতের কাজের রুমাল বা ব্যাগ উপহার দিলো ওকে ।


কোথা দিয়ে দিনগুলি কেটে গেলো পলকে । নৌসাদ চাচা খবর পেয়ে এলেন । তিনি বাংলা জানেন , ভালো বাংলা বলেন ; কলকাতায় গেলে বড়বাজারে ওঠেন । তারপর বালিগঞ্জ এলাকায় শাল সাপ্লাই করেন । মৌলির শ্বশুর বাড়ি ডোভার লেন তার জানা এলাকা । আর দিন দশেকের মধ্যেই কলকাতা যাবেন উনি ;ব্যবসার জন্য । প্রয়োজন হলে মৌলিক সেখানে সঙ্গে করে পৌঁছে দেবেন।


—–‘কাশ্মীর আগে এরকম ছিল না ,এখন রাজনৈতিক কারণে সাধারণ মানুষদের কষ্ট আরও বেড়ে গেছে। কতজন মারা যাচ্ছে বেঘোরে ; সময়ে সময়ে রুটি -রুজি সব বন্ধ ‘—-আপন মনে গম্ভীর গলায় বলে ওঠেন নৌশাদ চাচা ।



দুদিন পরে কারফিউ উঠলে শাহিদার বাবা বাড়ি ফিরে মৌলিকে বোরখা পরিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে শ্রীনগরে ওদের হোটেলে পৌঁছে দিলেন । যাবার সমত ওরা কাঁদছিলো সবাই ; শাহিদা ,আনোয়ার ,ফরিদা ,গুলশন ,আরও সব নতুন বন্ধুরা । মৌলিও কাঁদছিলো নিজের অজান্তে , শেরু ওর দুঃখী চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো । নৌসাদ চাচার মোবাইল নম্বর নিয়ে নিয়েছে মৌলি ,ওর বাড়ির ঠিকানা আর দেবমাল্যর মোবাইল নম্বর দিয়ে দিয়েছে ।


শ্রীনগরে ফেরার পর দেবমাল্য হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো ; ওকে ফেরত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলো সবাই । গাড়িটা অনেক নীচে খাদের ভিতর ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেছিলো খুনে দুটো ; গাড়িটা আগুনে পুড়ে অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছিলো —-কি হয়েছে বোঝা যায়নি । বারবার অনুরোধ করার পরেও নৌসাদ চাচা টাকা নিতে অস্বীকার করেছেন ,বলেছেন —‘ মৌলি আমাদের ঘরের বোনের মতো ,ওকে ফিরিয়ে দিয়ে টাকা নেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না —আল্লাহর মেহেরবানী যে ওর কোন ক্ষতি হয় নি ,আমরা উপলক্ষ্য মাত্র । ‘


বোঝা যায় নি যে কিভাবে মৌলির স্বভাব পাল্টে গিয়েছে আমূল । যে মেয়ে কোনোদিন নিজের প্রসাধন আর রূপচর্চ্চা ছাড়া আর কিছু বুঝতো না , সে পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে ,কাজ করছে আর টাকা পাঠাচ্ছে নৌসাদ চাচার মাধ্যমে, ফেলে আসা বন্ধুদের জন্য । এখন প্রত্যেক বছরে একবার করে কলকাতায় চাচার সঙ্গে দেখা করতে আসে ।


একটা এমব্রয়ডারি করা কাশ্মীরি সালের অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছে মৌলি –শাহিদা ,আনোয়ার আর গ্রামের বন্ধুদের জন্য । এখন ওর স্বপ্ন মাঝে মাঝে কাশ্মীর গিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা করে আসার । শিগগীরই নাকি ওদের গ্রামের কাছে মোবাইলের টাওয়ার বসবে ; সেদিন থেকে ওদের যোগাযোগ হবে আরও দ্রুত ।


দেবমাল্য ও মঞ্জুলিকা মৌলির এই অভাবনীয় পরিবর্ত্তনে আশ্চর্য্য হয়ে গেছেন । সত্যিকারের ভালোবাসার পরশমনি তাহলে মানুষের অন্তঃকরণকে সোনা করে দিতে পারে !



সৌজন্যে – প্রতিলিপি

Related News

Also Read