Select Language

[gtranslate]
৩০শে পৌষ, ১৪৩১ মঙ্গলবার ( ১৪ই জানুয়ারি, ২০২৫ )

।।। অভিশাপ ।।।

জয়ন্ত ঘোষ : – মাত্র দু থেকে তিন দিনের একটা অনুষ্ঠানের শেষে একটা মেয়ের জীবন যে কোথা থেকে কোথায় চলে যায়, তা আমার চেয়ে কেউ বোধহয় কেউ অনুভব করতে পারবে না । পুরুতমশাইয়ের কয়েকটা মন্ত্রের বুলিতে একটা শক্ত আঠা দিয়ে আটকানো ঠিকানা যে কিভাবে বদলে যেতে পারে, সত্যি ! ছোটবেলা থেকে যে বাড়িতে বড় হলাম, প্রতিটি দেয়াল, মেঝেতে আমার যেখানে প্রতিটি মুহূর্তের ছবি জড়ানো রয়েছে, ব্যস ! আজ থেকে আমি এ বাড়ির কেউ নোই ? এটা ভাবতেই তো বুকের ভিতর জমে থাকা যন্ত্রনা যেন মোচড় দিয়ে এসে বাইরে বেরিয়ে যেতে চায় !
কপালে চন্দনের ফোঁটা এঁকে দিতে দিতে নয়নাদি বার বার কান্নার জন্য আমায় বকা দিচ্ছিলো, শুধু বলছিলো, “এই দামড়া মেয়ে কোথাকার, বলছি না কাঁদিস না, আমার মেক-আপটা এতো সুন্দর করে করছি, শুধু শুধু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । আর একটু পরেই শ্বশুরবাড়ি থেকে সবাই এসে পড়বে, কি বলবে ? উল্টে আমাদের গাল-মন্দ করবে ! বলবে, মেয়েটাকে একটুও সাজিয়ে গুজিয়ে রাখতে পারে নি ! কি ফামিলিরে বাবা !”

না, কেউ কোনো কিছু কটু কথা আমায় বলে নি, কি মিষ্টি মুখ, কি সুন্দর গায়ের রং, যা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, সেটাই অন্যরকম সুরে, অন্যরকম ভঙ্গিমায় আমাকে সবাই বলেছে ! শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখলাম সব কিছু সিস্টেম্যাটিক, বাঁধা-ধরা কিছু কথা, বিশেষত আমার স্বামীর মুখ থেকে, “মাকে দেখবে, মার্ কথা শুনবে, এ বাড়ির বড়োদের মুখেমুখে তর্ক করবে না এইসব !” আসলে সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার মুখ বুজে মেনে নাও, আমরা যা কিছু বলবো, তার কোনোরকম নড়ন চরন যেন না হয়, এইরকম ! সত্যি কথা বলতে কি, খাঁচায় ভরা পাখির মতন ওদের একটা খেলনার মনে হয় খুব দরকার ছিল, পেয়ে গেছে, ব্যাস এরপর শুধুই আরো একটু যতটা পারো ট্রেনিং দিয়ে যাও, যাতে আস্তে আস্তে সে রোবট হয়ে যায়, তারপর দম দেওয়া খেলনার মতন যা বলবো তাই করো ।

প্রথম প্রথম সব কিছু মেনে নিয়েছি, কিছুটা মুখ বুজে, কিছুটা যন্ত্রনা, যতটা সহ্য করা যায়, ততটা প্রানপনে চেষ্টা করেছি । কোন মেয়েই বা চায়, নিজের সংসার নিজের হাতে ভেঙে ফেলতে ! বাবা৭ ধার-দেনা করে কত কষ্ট করে বিয়ের ব্যবস্থা করেছে, মা-দাদা শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবে, আত্মীয়-স্বজনরাই বা কি বলবে, কি রে বাবা, মেয়ে হয়ে জন্মেছে একটুও সহ্য-শক্তি নেই, এর দ্বারা সংসার-টংসার করা হবে না । না আমি পারি নি, আসলে একটা সময় পর্যন্ত মেনে নেওয়া গেলেও, পরে আর পারা যায় না ! ব্যাস, সে শ্বাশুড়ি-স্বামীর কি সব কথা, “ঘনঘন বাপের বাড়ি যাও, কিছু বলা হয় না, পার্টিতে গিয়ে বসের কাছে গিয়ে একটু বসতে বললাম, না আমি পারবো না, আমার সতীত্ব চলে যাবে ! আরে বাবা, এতদিন বিয়ে হয়েছে, সতীত্ব আবার কি ? ব্যবসার বড় কন্ট্রাক্টটা তো পেয়ে যেতাম ! নিজে তো বলতে গেলে খালি হাতেই এবাড়ি এসেছো, এক পয়সাও রোজগার করার সামর্থ্য তো নেই, শুধু সারাদিন গাঁক গাঁক করে গেলা আর ঘুমানো !”

এক বুক আশা নিয়ে মেয়েদের সংসার করতে আসা আর সমুদ্রের ঢেউর মতন হতাশা নিয়ে ফেরা, না কেমন যেন মাথাটা ঘুরছে, অন্ধকারে যেন তলিয়ে যাচ্ছি, সমুদ্রের লম্বা লম্বা ফেনিল ঢেউ যেন এসে আমাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, নাক মুখ ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে । মনে জমে থাকা কষ্ট, যন্ত্রনা, হতাশা, অপমান আর সহ্য করতে পারছিলাম না, ক্রমশ ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে ! আর, পারছি না !


আমার ঘুম ভেঙেছিল দু-দিন পরে, একটা নার্সিং-হোমে শুয়ে রয়েছি, চোখ মেলে চাইতেই দেখি বাবা-মা, বুবু দা সবাই দাঁড়িয়ে আছে । আমি উঠতে চেষ্টা করতেই, মাথাটা ঘুরে গেলো, ঘাড়টাকে ঝুলিয়ে শেষকালে মাথাটা হেলিয়ে দিলাম বালিশে, চোখের কোণ থেকে শুরু করে সমস্ত মাথাটাই কেমন যেন ভার হয়ে রয়েছে ।


-“কি রে খুব কষ্ট হচ্ছে না ?” -মার অকৃত্তিম, স্নেহ মাখানো গলায় প্রশ্নের উত্তরে বললাম,
-“অনেক গুলো একসাথে খেয়ে নিয়েছিলাম মা, আমি আর বাঁচতে চাইনি, অপমান, অত্যাচার, আমি নিজেকে ওদের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না, ফিরতেও চাইনি তোমাদের কাছে ! তাই………।”


বুকের ভিতর থেকে ডুকরে ওঠা কান্নার স্বরে মা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো । বাবার মাথায় হাত বোলানো দেখে সেই ছোটবেলার স্কুলের কথা মনে পরে যাচ্ছিলো । প্রথম দিন স্কুলে গেছি, শুধুই কেঁদেই যাচ্ছি, বাবা একবার করে গেটের বাইরে যাচ্ছে, আবার পিছনে ফিরে স্কুলের কাছে চলে আসছে ! না প্রথম দিন ছুটি হবার পরই আমাকে সঙ্গে নিয়ে তবেই বাড়িতে ফিরেছিল !


একটু পরে একজন পুলিশ অফিসার এসে জোরে চিৎকার করে আমাকে জেরা করতে লাগলেন,
-“কি ব্যাপার ? আত্মহত্যা করতে গেছিলেন ? জানেন এর জন্য কত বড়ো শাস্তি হতে পারে আপনার ?”
আমি বললাম,
-“আপনার কি মনে হয়, একজন বিবাহিতা মেয়ে শুধু শুধু ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করতে যায় ?”
এবার একটু গলার ভয়েসটা আস্তে করে বললেন,
-“তাহলে, পুরো ব্যাপারটা খোলসা করে বলুন তো, নাম বলুন, যারা আপনাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিল । সব কটাকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবো, দেখবো কে আমায় আটকায় ! আমাকে চেনে না !”


মনে হলো, এই অফিসার মানুষটি কর্তব্যপরায়ণ হলেও, ভীষণ আবেগী, তারও হয়তো একটা মেয়ে আছে, আমার মতন, যে অনেক স্বপ্ন নিয়ে সংসার করতে গেছিলো, কাদায়-জলে সমস্ত শরীরটাকে ডুবিয়ে সেও হয়তো আমার মতনই আর্তনাদ করেছে ! এরপর আমার হয়তো ঘুম ভেঙেছে, তার হয়তো ভাঙেনি, কেউ চেষ্টাও হয়তো করেনি ঘুম ভাঙানোর !



সৌজন্যে – প্রতিলিপি

Related News

Also Read