বৈশাখী দেবনাথ :- “মা, ও মা সন্তু বলেছে আজ নাকি রথ। ও আর ওর ভাই নাকি মেলায় যাবে বিকেলে। ওর বাবা বলেছে বিকেলে কারখানা থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে মেলায় নিয়ে যাবে ওদের।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে দেবু। রুমা আর অরবিন্দর একমাত্র ছেলে হলো দেবাশীষ ওরফে দেবু। পাড়ায় শান্তশিষ্ট ও ভদ্র বলে খুব সুখ্যাতি দেবুর। আর হবে নাই বা কেন? এই রেল কলোনির বেশিরভাগ বাচ্চা হয় দোকানে কাজ করে নয়তো সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। দেবু কিন্তু রোজ স্কুলে যায়। ক্লাস থ্রীতে পড়ে ও। ওর মা রুমা সকাল থেকে রাত অবধি লোকের বাড়ি কাজ করে। আর বাবা অরবিন্দ ভ্যানরিক্সা চালায়। রুমার চোখে অনেক স্বপ্ন, তার দেবু একদিন পড়ালেখা করে মানুষের মত মানুষ হবে। বড় অফিসে চাকরি করবে, বড় বাড়িতে থাকবে। তাদের মত এই বস্তিতে আবার মানুষ থাকে নাকি? দিনরাত পরিশ্রম করেও মানুষগুলো দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতে পারে না। একটা ঝুপড়ি ঘরে একগাদা মানুষ কোনমতে রাত কাটায়। এটা কোন জীবন হলো নাকি? ওর দেবু নিশ্চয় একদিন বড় হয়ে এখান থেকে বেরোতে পারবে।
— ” কি হলো মা, নিয়ে যাবে তো?”
— ” সে বিকেল হোক , তখন দেখা যাবে”।
–” না না মা, নিয়ে চলো না। আমি কোনদিনও রথের মেলায় যাইনি। প্রতিবার তুমি শুধু বল নিয়ে যাবে। এবার আমি যাবই” ।
ছেলের কথার কি উত্তর দেবে ভাবছিল রুমা। ওর ও খুব ইচ্ছে হয় ছেলেকে নিয়ে একটু আমোদ-আহ্লাদ করতে। কিন্তু বিকেলে ঘোষ বাড়িতে রান্নার কাজ থাকে। আর ঘোষ মাসীমা খুব মেজাজী মানুষ। কাজে ফাঁকি দেওয়া উনি পছন্দ করেন না। কাজে ঢোকার সময় উনি পরিষ্কার বলেছিলেন , শরীর খারাপ ছাড়া অন্য কোনো কারণে তিনি ছুটি দিতে পারবেন না। এরপরও যদি ছুটি নেয় তবে মাইনে কেটে রাখবেন। এই শর্তে কাজ করলে ভালো নইলে ওনার কাজের লোকের অভাব হবে না। এমনিতে মানুষটা কড়া হলে কি হবে, মনটা খারাপ নয়। মাস শেষ হতে না হতেই টাকাটা দিয়ে দেন। আবার পুজো, পয়লা বৈশাখে শাড়িও দেন। আবার যেদিন মাংস হয় , সেদিন দু’ পিস মাংস দেন রুমার ছেলের জন্য।এহেন ঘোষ মাসীমার কাছে ছুটি চাওয়ার সাহস রুমার হয়নি কোনদিনও। অন্য কোনো বাড়ি হলে তাও অনুরোধ করত।
দুপুরে অরবিন্দ খেতে আসার পর রুমা তাকে বলে….
— ” হ্যাঁ গো শুনছো, ছেলেটা মেলায় যাওয়ার জন্য খুব বায়না ধরেছে। কি করি বলতো”?
–” কি আর করবে বলো, প্রতি বারের মত এবারও ও বিকালে খেলতে গেলে তুমি কাজে চলে যেও। মেলার ওখানে আজ কিছু ভাড়া পাবো, তাই আমাকেও কাজে যেতে হবে ” ।
–” ছেলেটার ছোট্ট একটা ইচ্ছে পূরণ করব তাও পারিনা, কি অভাগা মা-বাবা আমরা” ।
–” কোন উপায় তো নেই রুমা। চালের টিন দিয়ে বেশ কয়েক জায়গায় জল পড়ে। আজকে যদি কিছু বেশি ভাড়া হয় আর তোমার এ মাসের কিছু মাইনে নিয়ে চালটা ঠিক না করলেই নয়” ।
–” সেই গো। আজকে রাতে দেখো কাঁদতে কাঁদতে না খেয়ে ঘুমোবে ছেলেটা”।
–” আমি ওর জন্য একটু জিলিপি আর বাদাম এনে দেব। দেখো বেশিক্ষণ রাগ করে থাকবে না ” ।
খাওয়া – দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে অরবিন্দ তার ভ্যানরিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রুমাও এঁটো বাসনপত্র ধুয়ে এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। দেবু খেলতে যাবে এবার, ওর বন্ধু সন্তু এসেছে ওকে ডাকতে।
–” মা তুমি নিয়ে যাবে তো মেলায়, বলো”?
–” হ্যাঁ বাবা যাবো। তুই এখন খেলতে যা , সন্তু দাঁড়িয়ে আছে” ।
–” সন্ধ্যে বেলায় যাবো তবে, ভুলে যেওনা। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো দেখো” ।
–” যাও বাবা, তাড়াতাড়ি চলে এসো” ।
ছেলেকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে নিজেরই কান্না পেয়ে যায় রুমার। কিন্তু সে নিরুপায়। ঘরে তালা দিয়ে পাশের বাড়ির কণিকা মাসীমার কাছে রোজকার মত চাবি রেখে ঘোষ বাড়ির পথে পা বাড়ায় রুমা।
আজ আর কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিল না রুমা। ঘোষ বাড়িতে ঘোষ মাসীমা ছাড়াও আছেন তাঁর ছেলে-বৌমা ও আট বছরের নাতনি তিতলী। মাসীমা রাতে লুচি, আলুরদম আর চাটনি রান্নার নির্দেশ দিয়েছেন। লুচির ময়দা মাখতে মাখতে বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছিল রুমা। কখন পেছনে তিতলী এসে একটু জল চাইছে সে খেয়ালই করেনি। তিতলী রুমাকে বড় ভালোবাসে। সে এলেই পিসি,পিসি বলে এটা ওটা খাবার বায়না করে।রুমাও যত্ন করে তিতলীর সব আবদার পূরণ করে।শেষমেশ তার আঁচলে টান পড়তেই সম্বিত ফেরে রুমার।
–” ওমা তিতলী মামনি যে, বলো কি বলবে” ।
–” তোমার কাছে সেই কখন থেকে একটু জল চাইছি , শুনতেই পাচ্ছনা তুমি। কি ভাবছিলে গো পিসি”?
–” কিছু না মামনি। এই নাও জল” ।
–” জানোতো পিসি , আজকে পাপা অফিস থেকে ফিরলে আমরা সবাই রথের মেলায় যাবো” ।
–” ওমা তাই নাকি!”
–” হ্যাঁ গো, পাপা বলেছে আমাকে খুব সুন্দর একটা ড্রেস পরে তৈরি থাকতে” ।
–” বাঃ খুব সুন্দর সাজুগুজু করে মেলায় যেও” ।
–” ও পিসি তুমি দেবুকে নিয়ে যাবে না মেলায় “?
ছোট্ট এই মেয়েটির কাছে যেন আর নিজের হতাশা লুকাতে পারলনা রুমা। বলেই ফেললো যে, তারও খুব ইচ্ছে করছে দেবুর হাত ধরে মেলায় যায়।দেবুটাও খুব বায়না করছিল মেলায় যাওয়ার জন্য।কিন্তু উপায়ও যে নেই কোন। তাদের বাড়ির রান্নার কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত আটটা বেজে যাবে।তারপর আর অত রাতে মেলায় যাওয়া হবে না। কারণ নয়টা বাজলে দেবু আর জেগে থাকতে পারে না। রুমার কথা শেষ হতে না হতেই মাসীমা হাঁক দিলেন….
–” রুমা একটু চা বসাও তো, তোমার দাদা ফিরলেন” ।
–” এই বসাচ্ছি মাসীমা” ।
বলে রুমা আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।তিতলীও চলে গেল। চা আর হালকা একটু স্ন্যাকস নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখতেই মাসীমা ডাক দিলেন তাঁর ঘরে আসার জন্য।
–” হ্যাঁ, বলুন মাসীমা কিছু লাগবে আপনার”?
–“তোমার কাজ কদ্দুর? ময়দা মেখে লেচি কেটে রেখেছি। আলু কেটে সিদ্ধ বসাবো এবার” ।
–” ও তবে এক কাজ করো; আলুটা কেটে সিদ্ধ বসিয়ে, মিক্সিতে মসলাটা করে তুমি বরং আজ বাড়ি চলে যাও” ।
–” কেন মাসীমা? আমার কি কোন ভুল…..
কথা শেষ করতে পারে না রুমা। তার আগেই ঘোষ মাসীমা একটা দুইশ টাকার নোট রুমার হতে গুঁজে দিয়ে বলে….
—” এই নাও, তোমরা মা-ব্যাটায় একটু জগন্নাথ দর্শন করে এস।তিতলী আমাকে সব কথা খুলে বলেছে। তুমি আমাকে ভয় পাও বুঝতে পারি। কিন্তু সব কিছুর উর্ধ্বে আমিও তো একজন মা। তাই ছোট ছেলের সামান্য একটু বায়না না মেটাতে পারার যে কষ্টটা হয় সেটা আমিও বুঝি। যাও এবার তাড়াতাড়ি হাতের কাজটুকু সেরে নাও। আজ না হয় আমিই রান্নাটা করে নেব” ।
এতটা খুশি বোধহয় রুমা আগে কখনো হয়নি।তাই সামলাতে না পেরে চোখ দিয়ে দু’ ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।
—” দূর বোকা মেয়ে, কাঁদছ কেন? যাও তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নাও। নইলে দেবু আবার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়বে যে” ।
–” এই যাই মাসীমা” ।
বলে দ্রুত হাতে কাজটুকু সেরে, মাসিমাকে বলে বাড়ি থেকে বের হয় সে। ছোট্ট হাত ব্যাগটা থেকে বোতাম টেপা ফোনটা বের করে অরবিন্দকে কল করে।
—” হ্যালো, দেবুর বাবা শুনছো? তুমি বাড়ি এসো , আজ আমরা তিনজনে রথের মেলায় যাবো।কাজ তো সারা জীবন করবই। কিন্তু ছেলে বড় হলে এই রকম ছোট আবদার আর করবেনা।তুমি তাড়াতাড়ি এসো। আমিও বাড়ি ফেরার রাস্তায় আছি” ।
এরপর তিনজনে অরবিন্দর ভ্যানরিক্সায় চেপে রথের মেলার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দেবুর চোখের সেই খুশির ঝিলিক হাজার হীরক খন্ডের দ্যুতিকেও হার মানায়।
⭕আরো সংবাদের জন্যে নীচের লিংক গুলোতে ক্লিক করুন👇
https://www.facebook.com/neelushik?mibextid=ZbWKwL
https://youtube.com/@ekhansangbad5105
সংবাদ // বিজ্ঞাপন – এর জন্য যোগাযোগ করুন – ৭০০১৯৮১০২৬ , ৯৯৩২৪৫০৫৪৫