সুস্মিত মিশ্র
মাছের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক চিরন্তন। আর কিছু হোক বা না হোক, খাবার পাতে একটু মাছ হলেই অনেকের হয়ে যায়। আর তার সঙ্গে যদি থাকে মাছের ডিমের বড়া, তাহলে তো কথাই নেই! সেটাই হয়ে উঠেছিল আরেক বাঙালির গবেষণার বিষয়। ডঃ হীরালাল চৌধুরী হয়তো আমাদের কাছে বেশি পরিচিত নাম নন, কিন্তু তাঁর কাজকে সম্মান জানিয়েছে গোটা বিশ্ব। বাংলার ছেলেটাই হয়ে গেল সারা বিশ্বের ‘প্রণোদিত প্রজননের জনক’।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২১ নভেম্বর অধুনা বাংলাদেশের সিলেটের সুরমা ভ্যালি সংলগ্ন কুবাজপুর গ্রামে জন্ম হীরালাল চৌধুরীর।তখন সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশভাগের ক্ষত তাজা, দগদগে। কাঁটাতারের দুই পাড়ে আশ্রয় খোঁজার জন্য জড়ো হয়েছে বহু মানুষ। সেরকমই এক যুবক ভাগ্যের নদীতে চেপে চলে আসেন ব্যারাকপুর। সেখানকার মণিরামপুর সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিসারিজ রিসার্চ স্টেশনে চাকরিসূত্রে যোগ দেন।
ব্যারাকপুরের কেন্দ্রে থাকার সময়ই তিনি লক্ষ্য করেন – গঙ্গার ধারে ইটভাটায় জোয়ারের জলে ভেসে আসা পেটফোলা মাছ ধরে টিপে দিতেই ডিম্বাকৃতি স্বচ্ছ ডিম বেরিয়ে আসছে এবং কয়েক ঘণ্টা এক পাত্রে রাখার পর জীবনের
সঞ্চার প্রত্যক্ষ হচ্ছে – এই লক্ষ্যটিই – হীরালালকে ‘প্রণোদিত প্রজনন প্রক্রিয়া’সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার দিকে আকৃষ্ট করে। কটকের মৎস্য গবেষণাগারে সিনিয়ার রিসার্চ অ্যাসিস্টান্ট হিসাবে মাছের এন্ডোক্রাইনোলজি ও ফিজিওলজির
উপর দীর্ঘ নয় বৎসর গবেষণা করার পর ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই কার্প প্রজাতির মাছের প্রণোদিত প্রজনন পদ্ধতিতে সাফল্য লাভ করেন যা প্রাণীবিজ্ঞানে প্রথম সারির এক মৌলিক কাজ হিসাবে পরিগণিত হয়। এর আগে
পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও এই প্রক্রিয়ায় মৎস্য প্রজনন সম্ভব হয় নি। জাপানের খ্যাতনামা মৎস্যবিজ্ঞানী ডাঃ কে. কুরোনুমা বাঙ্গালী বিজ্ঞানী হীরালালকে ‘প্রণোদিত প্রজননের জনক’ বলে অভিহিত করেন। হীরালাল কেবল প্রণোদিত প্রজননেরই জনক নন, পরবর্তীতে তিনি পুকুরে মৎস্যোৎপাদন বৃদ্ধিতে নিবিড় মিশ্রচাষের দিশা প্রদর্শক।
১৯৫৭ সালের ১০ জুলাই কটকেই প্রথমবার এই প্রণোদিত প্রজনন বা ইনডিউসড ব্রিডিং পদ্ধতিটির সাফল্য প্রমাণ করেন হীরালালবাবু। তারপর বহু দেশে এই প্রক্রিয়া নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। আজ স্কুলপাঠ্য হিসেবেও তাঁর এই আবিষ্কার পড়ানো হয়। মাছ চাষের গোটা ছবিটাই বদলে দিলেন তিনি।১০ জুলাই তিনি প্রণোদিত প্রজনন পদ্ধতির আবিষ্কার করেছিলেন বলে এই দিনটিকে ভারত সরকার চিহ্নিত করেছেন ‘জাতীয় মৎস্যজীবী দিবস’ হিসেবে।
তিনি কার্প প্রজাতির বারো রকমের নতুন শঙ্করীকরণ, আঁতুড় পুকুরের ডিমপোনা কোন কোন পোকার দ্বারা আক্রান্ত ও তার প্রতিকার এবং বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আঁতুড় পুকুর পালনের পদ্ধতির উপায় বিশদে দেখিয়েছেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে অবসর পর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উপদেষ্টা হয়ে সুদান, নাইজেরিয়া, ফিজি, লাওস, ফিলিপাইন, মায়ানমার সহ বহু বিশ্বের বহু দেশে কাজ করেছেন, তার তিন দশকের অভিন্নতা ও প্রযুক্তিগত বুদ্ধিমত্তা মৎস্য উৎপাদনে ও জলজ পালন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান সেদেশের মানুষদের সামনে পরিস্ফুট করেছেন। হীরালাল চৌধুরী ফিলিপিনসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিশারিজ উন্নয়ন কেন্দ্রের বা এসইএফডিইসি-র আঞ্চলিক সমন্বয়কারী ও সহকারী অধিকর্তা , ফিলিপাইনের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাকোয়াকালচারের পরিদর্শক বিজ্ঞানী ছিলেন।
ডঃ হীরালাল চৌধুরী হয়তো আমাদের কাছে বেশি পরিচিত নাম নন, কিন্তু তাঁর কাজকে সম্মান জানিয়েছে গোটা বিশ্ব। তকমা পেলেন ‘প্রণোদিত প্রজননের জনক’ -এর।
যে আবিষ্কারের জন্য এখন একশো-দেড়শো টাকায় রুই-কাতলা মাছ বাঙ্গালীর পাতে উঠছে, মৎস্য চাষে সবুজ বিপ্লব ঘটানো সেই বিজ্ঞানী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ৯বছর আগে,২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ।ডঃ হীরালাল চৌধুরী কলকাতায় ৯৩ বৎসর বয়সে প্রয়াত হন।১০ জুলাই ‘ফিশ ফার্মার্স ডে’ বা ‘জাতীয় মৎস্যজীবী দিবস’ ঘোষণা ছাড়া বঙ্গবিভূষন -পদ্মশ্রী-পদ্মভূষণ-পদ্মবিভূষণ কোনো তকমাই জোটেনি এই আবিষ্কারকের। আর ভারতরত্ন, সে তো দুর অস্ত্।
সমগ্র বাঙ্গালীর হয়ে নতমস্তকে এখন সংবাদ পরিবার এই মহান মানুষটিকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছে