অর্পিতা সরকার :- আমার বাবার মুখাগ্নি আমি করবো ঠাকুরমশাই। জল শুকনো চোখে তীব্র গলায় কথাটা বললো শ্রেয়সী। সঙ্গে সঙ্গে জেঠু গম্ভীর স্বরে বললেন, না শ্রেয়সী, সেটা হয় না। তোর নিজের দাদা নেই তো কি হয়েছে, আমরা তো আছি? জেঠতুতো দাদা কি দাদা নয়? অনিরুদ্ধই মুখাগ্নি করবে ইন্দ্রনীলের। শ্রেয়সী নীরব জেঠুর কথায়। শুধু পুরোহিতকে নির্দেশের সুরে বললো, আমিই করবো। সমস্ত শ্মশানযাত্রীর মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে। মেয়ে হয়ে মুখাগ্নি করবে? এতো এই বংশের অপমান। বংশধর না থাকলে তবেই লোকে এসব ভাবে আজকাল। ইন্দ্রনীলের যখন ভাইপোরা আছে, তখন এসবের মানে কি?
ছোটকাকু ধীরে ধীরে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সবই দেখছে শ্রেয়সী। বৌদি, তুমি শ্রেয়সীকে বোঝাও। ও আমাদের অপমান করছে। চ্যাটার্জী বংশের মেয়ে হয়ে ও শ্মশানে গিয়ে মুখাগ্নি করবে কি করে? আমাদের বংশের মেয়েরা কেউ শ্মশানে যায় না। পাড়ার লোক কি বলবে বলোতো! আমরা কি মরে গেছি? তাছাড়া তোমার মেয়ে এখন বিখ্যাত হয়েছে, হয়তো মিডিয়া এসেও হাজির হবে। সবাই কি বলবে, কাকা, জ্যাঠারা থাকতে বাচ্চা মেয়েটা একা এসব করছে! তোমার মেয়ের নাহয় বুদ্ধি নেই বৌদি, কিন্তু তোমার তো আছে। আর ওটা তো আমাদেরও দাদা নাকি।
মা ধীর স্বরে বললো, তোমার দাদা যা বলে গেছেন, সেই মতই হবে। মরা মানুষটাকে নিয়ে আর তোমরা ঝগড়া করতে এসো না ঠাকুরপো।
শ্রেয়সী ধীর স্বরে বললো, জেঠু, কাকু, পিসিমনি তোমাদের একটা কথা বলি, বাপি তার পুরোনো ডায়রিতে পরিষ্কার নিজের ইচ্ছের সব কথা লিখে দিয়ে গেছে। আমি শুধু বাপির ইচ্ছে মত কাজ করছি। পিসিমনি কাঁদতে কাঁদতেই বললো, কি ডায়রি, কি ইচ্ছা? তোর বাবা তো আমাদেরও দাদা ছিল রে। তার ইচ্ছের খবর আমাদেরও জানা উচিত। তুই নিয়ে আয়, দাদার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়েই শুনবো দাদার ইচ্ছের কথা।
ছোটকাকু বললো, হ্যাঁ শোনা তো দরকার, বসত বাড়িটা হয়তো আমাদেরই ভাগে দিয়ে গেছে। তুই তো মেয়ে, তারপরে আবার সেলিব্রিটি, তুই হয়তো আর এখানে থাকবিই না, ফ্ল্যাট কিনবি।
একটা সাদা চাদরে ঢাকা দেওয়া আছে ইন্দ্রনীল চ্যাটার্জীর মৃতদেহ। আর তার রক্তের সম্পর্কের ভাইবোনেরা মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়েই সম্পত্তির হিসেব কষতে ব্যস্ত। শ্রেয়সীর বমি উঠে আসছিল। একরাশ ঘৃণা জমা হচ্ছিল নিজের লোকেদের ওপরে।
শ্রেয়সী দৃপ্ত পায়ে ঘরে ঢুকলো। একটা ভেলভেট চটে যাওয়া ডায়রি নিয়ে ফিরল।
জেঠুর ছেলের হাতে দিয়ে বললো, দাদাভাই, তুই পড়ে শোনা।
দাদাভাই একটু ইতস্তত করে ডায়রিটা নিয়ে পাতাটা খুললো…..
প্রিয় মামনি,
বলতো মামনি, আমার জীবনের সব থেকে আনন্দের দিন কোনটা? যেদিন হসপিটালের বেডে তোর মায়ের পাশে ছোট্ট তোকে দেখেছিলাম। আর যেদিন তোর প্রথম গানের ক্যাসেট বেরোলো ওই দিন। না রে, ভুল বললাম… আরও আছে, তোর প্রতিবার রেজাল্টের দিনও আমার বড্ড আনন্দ হতো। বাচ্চাদের মত কেঁদে ফেলতাম। তোর মা বলতো, মেয়ে আরও সকলের আছে গো, তোমার মত
এমন আদিখ্যেতা কেউ করে না। আমি বলতাম, আমার মেয়ের মত মেয়ে কজনের আছে গো! মামনি, তুই কি কষ্টে আছিস! তোর মুখে ইদানিং বড্ড চিন্তার ছাপ দেখছি। জানি তুই কেন কষ্ট পাচ্ছিস।
তুই যতই আমার কাছে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করিস আমার কি রোগ হয়েছে, আমি কিন্তু জেনে গেছি মা। আমার লিভারের বায়োপসি রিপোর্টে ম্যালিগন্যান্ট ধরা পড়েছে। আমি জানি ট্রিটমেন্টে অনেক টাকা খরচ হবে। কিন্তু মামনি, আমি সারাজীবনে কিছুই যে জমাতে পারিনি রে। তোর আর তোর মায়ের জন্য কিছুই করতে পারলাম না রে।
জানিস মামনি, তুই যখন এই নামী নার্সিংহোমে আমায় ভর্তি করলি তখনই আমি বুঝেছিলাম, তুই এবারে আমার জন্য তোর প্রতিভা বেচবি। তাছাড়া তোর কাছে রাস্তাই কি ছিল!
এতদিন আমি তোকে গানের প্রোগ্রামে নিয়ে যেতাম। আর বলতাম, মনের আনন্দে গান কর, গান নিয়ে ব্যবসা করিস না। তুই বলতিস, বাপি, অমুক ক্লাব থেকে এত টাকা অফার করেছে। আমি বলতাম, টাকা নিবি গান গেয়ে? তুই বলতিস, সবাই নেয় বাপি। আমারও পকেটের অবস্থা জরাজীর্ণ, তাই চুপ করেই ছিলাম। ক্লাস সেভেন থেকেই তুই স্টেজে পারফর্ম করতে শুরু করলি। চারিদিকে তোর কত নাম হচ্ছিলো। আমার বুকটা গর্বে ভরে উঠছিল।
জানিস মা, তুই যখন জন্মালি তখন তোর ঠাকুর্দা মানে আমার বাবা বলেছিলেন, খুব আশা করেছিলাম, ছেলে হবে। মেয়ে হয়ে বংশের কোন কাজে লাগবে?
তোর জেঠু বলেছিল, বিয়ের পাত্র খোঁজা ছাড়া আর কি কাজ!
তোর পিসি বলেছিল, গায়ের রংটাও তো চাপা। গয়না গড়াও এখন থেকেই। একগাদা পণ নিয়ে তবে কেউ এই কালো মেয়েকে বিয়ে করবে।
তোর মায়ের চোখে সেদিন ভয় দেখেছিলাম। এদের এত কথা শুনেই হয়তো আতংক হচ্ছিল তোর মায়ের তোকে নিয়ে।
কিন্তু জানিস মামনি, আমার বড্ড আনন্দ হয়েছিল। একটা পুতুল পুতুল মেয়ে, আমায় বাবা বলে ডাকবে বলে।
তোর ছোট কাকাকে ব্যবসার জন্য অনেকগুলো টাকা দিয়েছিলাম। আমার জমানো সব টাকা। বলেছিল, ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে শোধ করে দেবে। তুই হবার পরে তোর কাকা বলেছিল, যাক বাবা, দাদার তো মেয়ে হয়েছে, আর আমায় টাকা শোধ করতে হবে না। মেয়ের বিয়ের সময় একটা সোনার গয়না দিয়ে দেব ক্ষণ। তোর জেঠুর ছেলের পড়াশোনার জন্যও টাকা দিয়েছিলাম, তোর জেঠু বললো, তোর তো মেয়ে হয়েছে, আমার তো দুই ছেলে, তুই বরং একটার পড়াশোনার দায়িত্ব নে। আমি মুখ নিচু করে মেনে নিয়েছিলাম। তোর ভালো বেবিফুড কিনতে পারতাম না, তবুও দাদার ছেলের কোচিংয়ের টাকা দিতাম।
জানিস মামনি, চারিদিকে যে বলে না এখন ছেলে- মেয়ে সব সমান, সেই ধারণাটা ভেঙে গিয়েছিল তুই হবার পরে বাড়ির সকলের মানসিকতা দেখে।
তুই বড় হচ্ছিলি। একটু একটু করে, একদিন একদিন করে আমার চোখের সামনে। আমিই প্রথম খেয়াল করেছিলাম, তুই যখনই আনমনে থাকিস, তখনই গান করিস। আমি বলেছিলাম তোর মাকে, শ্রেয়সীকে গানের স্কুলে ভর্তি করে দিই।
তখন তোর সবে ক্লাস থ্রি। তোকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করলাম গানের স্কুলে। পড়াশোনাতেও তুই ছিলিস বাড়ির সকলের থেকে ভালো। তোর দুই দাদার থেকেও তুই অংকে বেশি পেতিস। তোর দাদু বলতেন, শ্রেয়সী বেশি পড়ে তো লাভ নেই রে। অনিরুদ্ধ আর অনির্বানকে পড়তে হবে। ওরাই বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। মেয়ে তো পরের বাড়ি চলেই যাবে, খরচ করে পড়িয়ে হবেই বা কি!
কিন্তু সকলের সব কথাকে মিথ্যে প্রমান করে তুই ভালো রেজাল্ট করেছিলিস। এমনকি মাধ্যমিকেও তুই জেলার সেরা হলি। বাড়ির সকলের হিংসার পাত্রী হয়ে গেলি। জানিনা সেটা তুই কন্যাসন্তান বলেই কিনা!
তুই ছেলেদের হারিয়ে দিচ্ছিলি বলেই বোধহয় আমরা একঘরে হয়ে গেলাম। তোর ছোট কাকার ছেলেটা অল্প বয়সে বখে গেল। তোর জেঠুর ছেলেগুলোও মিডিওকার স্টুডেন্ট। সেখানে তুই সবেতে ফার্স্ট, এটা মেনে নিতে পারছিল না কেউ। তাই হয়তো কোনো কারণ ছাড়াই তোর জেঠু একদিন বলে বসলো, তোরা আলাদা থাকিস ইন্দ্র।
জানিস মামনি, আমরা যেদিন আলাদা হলাম সেদিন আমার হাতে একটাও টাকা ছিল না। তোর মায়ের একটা গয়না বেচতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তুই এসে আমার হাতে হাজার পাঁচেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললি, বাপি যে রিয়ালিটি শো তে গান গাইছি, ওখান থেকে পেয়েছি। জানিস মা, গর্বে বুকটা ভরে গিয়েছিল। আমার ক্লাস ইলেভেনের মেয়ের প্রথম রোজকারের টাকায় আমার সংসারের হাঁড়ি, কড়া কেনা হয়েছিল। মনে মনে বলেছিলাম, আমার মেয়েই আমার লাঠি।
আমার বেসরকারি অফিসের স্ট্রাইকের সময় ক্লাস টুয়েলভের তুই হঠাৎ বললি, বাপি, আমি কটা টিউশনি করবো ভাবছি।
আমি তোর জেঠুর কাছে গিয়ে বলেছিলাম, চ্যাটার্জী বংশের মেয়ে টিউশনি করবে? সম্মানে লাগবে যে! আমার ভাগের জমিগুলো যদি আমায় দাও।
তোর জেঠু বলেছিল, তোর ভাগের জমি আবার কি রে?
তোর তো ছেলে নেই, তাই বাবা সব জমি আমাদের লিখে দিয়ে গেছেন।
তোর ভাগে কোনো জমি নেই। তাছাড়া তোর মেয়ে পড়াশোনা করে বিজ্ঞ হচ্ছে, সে টিউশনি করলে আমাদের করার কি আছে!
আমাদের কাছে হাত পাততে আসবি না।
তোর ছোট কাকা বলেছিল, দাদা, একটা ভালো বুদ্ধি দিই তোমাকে, মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দাও, তাহলে হয়তো ওই টাকায় তোমার ঘরে হাঁড়ি চড়বে।
ফিরে এসে বাইরের ঘরে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলাম।
দেখলাম দুটো ছোট ছোট মেয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এসে দাঁড়ালো, মিষ্টি করে বললো, শ্রেয়সী দিদি আছে?
আমরা পড়তে এসেছি। পড়াশোনা করে দিদির মত জেলার গর্ব হতে চাই।
জানিস মামনি, আমি কেঁদে ফেলেছিলাম ওইদিন।
আমার মেয়ে জেলার গর্ব!
বাইরের ঘরটা তোর ছোট ছোট স্টুডেন্টে ভরে গেল।
আমার অফিসের স্ট্রাইক উঠলেও মাইনে নিয়মিত হলো না। সংসার চলছিল তোর টিউশনির টাকায়। সাথে তুই গান গেয়েও রোজকার করছিলিস। তোর গানের ক্যাসেট বেরোলো, আমি চমকে গিয়েছিলাম। আমার মেয়ের সাফল্য দেখে।
রাস্তায় বেরোলেই সবাই বলতো, কাল টিভিতে আপনার মেয়ের প্রোগ্রাম দেখলাম ইন্দ্রনীলবাবু। বড় ভালো গায়। আমাদের জেলার গর্ব আপনার মেয়ে।
উচ্চমাধ্যমিকেও তুই ভালো রেজাল্ট করলি। তোর জেঠু, কাকুরা আমাদের বাড়ির মাঝে লম্বা পাঁচিল তুলে দিল। মুখে বললো, ভিখিরীরা কখন নুন, তেল চাইতে আসে, বিশ্বাস তো নেই। তোর মা খুব কেঁদেছিল জানিস মামনি। আর তুই বলেছিলি, বাপি মানুষ চিনতে শেখো।
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলি, আমি তো আছি বাপি, তোমার কোনো চিন্তা নেই। মনে রেখো তুমি নিঃসন্তান নও।
ঠিক আমার মায়ের মত আমায় ভরসা দিয়েছিলিস তুই।
জয়েন্টে চান্স পেয়েও তুই মেডিক্যালে পড়তে যাবি না সিদ্ধান্ত নিলি। বললি, বাপি অনেক খরচ। অনেকটা সময় সাপেক্ষ। এতদিন শুধু পড়াশোনার পিছনের ব্যয় করলে আমরা না খেতে পেয়ে মরবো বাপি। জানিস মা, সেদিন আমার নিজের ওপরে করুণা হচ্ছিল। আমি তোর বাবা হবার যোগ্য নয় বলে। তুই হয়তো আমার চোখ দেখে আমার কষ্টটা বুঝতে পেরেছিলিস। তাই বললি, বাপি আমি সিঙ্গার হতে চাই। ফিল্মে গান গাইতে চাই।
আমি বললাম, গান বেচবি?
তুই রক্তাভ চোখে জবাব দিয়েছিলিস, হ্যাঁ বেচবো।
এরমধ্যেই আমার রোগটা ধরা পড়লো। তুই ততদিনে দুটো বাংলা ছবিতে সাইন করেছিস আমাকে না জানিয়েই। আমি তখন অসহায় হয়ে ওই পাঁচিল টপকে আবার তোর কাকু, জেঠুদের বাড়িতে গিয়েছিলাম শুনে তুই বলেছিলিস, আমি মেয়ে বলে কি তোমার ভরসা নেই বাপি? আমি কি তোমার ট্রিটমেন্ট করাতে পারবো না? আমি তোমাকে সব থেকে নামী নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবো।
সেদিন আমি মনে মনে বলেছিলাম, ভাগ্যিস আমার মেয়ে হয়েছিল। ঘরে বসে তোর ছোটকাকুর চিৎকার শুনতে পেতাম, আমায় মারছিস কেন, আমার কাছে বাইক কেনার টাকা নেই রে। তোর ভাইয়ের অশ্রাব্য ভাষার কথাগুলো শুনে ভাবছিলাম, বাহ রে চ্যাটার্জী বংশের বংশধর! বংশের একটাই মেয়ে ছিলি তুই তবুও কদর পেলি না। সেই ছেলেই সেখানে পূজিত হচ্ছে। কুলাঙ্গার ছেলে!
আজ নার্সিংহোমে বসে বসে এফএমএ তোর গান শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিলো, মরতেও দুঃখ নেই আমার। আমি তো জীবনে সবটা পেয়ে গেলাম। নার্স থেকে ডক্টর সবাই এসে বলছে, মিস্টার ইন্দ্রনীল চ্যাটার্জী? ফাদার অফ শ্রেয়সী চ্যাটার্জী? ইউর ডটার ইজ সিরিয়াসলি এ রিয়াল জুয়েল। সি হ্যাজ ম্যাজিক্যাল ভয়েস।
জানিস মামনি, বড্ড গর্ব হচ্ছিল রে। আনন্দে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল।
বারবার ভাবছিলাম, ভাগ্যিস তুই জন্মেছিলিস আমার ঔরসে।
মামনি আমি হয়তো আর বেশিদিন নেই, তবে তুই কিন্তু তোর মাকে খুব যত্নে রাখবি। আমি তো পারিনি, তুই রাখবি। আরেকটা কথা, আমি মারা যাবার পরে একটু খেয়াল রাখবি, ওই বাড়ির কেউ যেন আমার মুখাগ্নি না করে। হয়তো ওরা তুই মেয়ে বলে বাধা দেবে, কিন্তু তুই বলবি, আমিই আমার বাপির একমাত্র সন্তান। ওদের হাতের আগুনে আমি স্বর্গে যাবো না রে মা।
তুই আমার একমাত্র বংশধর। আমি জানি, ইন্দ্রনীল চ্যাটার্জীর নামটা পৃথিবী থেকে কিছুতেই মুছতে দিবি না তুই। সকলকে বলবি, আমিই তোকে ক্লাস থ্রিতে গানে ভর্তি করেছিলাম। আমাকে তোর গানের মধ্যে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখিস মা।
আমার মৃতদেহ যেন ওবাড়ির কেউ স্পর্শ না করে।
তোর বাপি
চিঠিটা পড়া শেষ হয়েছে। মৃত্যু বাড়ির নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। এতক্ষন যে ফিসফাস হচ্ছিলো সব থেমে গেছে।
শ্রেয়সী জানতো, বাপি আর বাঁচবে না। মনে মনে প্রিপারেশন নিয়েই নিয়েছিল। আপাতত গানের জগতে নতুন মুখ হিসাবে ও বেশ পরিচিত। বেশ কিছু ফিল্মে গানের সুযোগও এসেছে। ডক্টররাও বলছেন, মিস শ্রেয়সী মনকে শক্ত করুন। মনকে কঠিন শ্রেয়সী করেই ফেলেছিল। তবুও চিঠিটা পড়ে অঝোরে কেঁদেছিল। আবার পাগলের মত আনন্দে হেসেছিলো, বাপি তাকে সন্তান ভাবতো, দুর্বল মেয়ে নয়। বাপি তাকে বংশধর ভাবতো।
শ্রেয়সী খেয়াল করলো, পাড়ার কয়েকটা লোকজন ছাড়া চ্যাটার্জী বাড়ির সকলেই চুপচাপ পিছু হাঁটা দিয়েছে।
শুধু জেঠুর ছেলে দাদাভাই এসে বললো, শ্রেয়সী তুই কাকুর মুখাগ্নি করবি, আমি তোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো।ওই আগুনে যদি একটু হলেও সংশোধন হয় আমার, সেটাই লাভের।
দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতাটা। শ্রেয়সীর হাতে জ্বলন্ত কাঠের টুকরো।
গঙ্গা স্নান সেরে ঘাটের ওপরে উঠলো শ্রেয়সী।
ছোটবেলার বান্ধবী মল্লিকা বললো, তোর ফোনে একটা ফোন এসেছিল। তুই তখন স্নানে নেমেছিলিস, আমি রিসিভ করলাম। দুঃখ একটাই কাকু জেনে যেতে পারলো না। ‘নীল নির্জনে’ সিনেমার প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসাবে তুই এ বছরের বেস্ট সিঙ্গারের প্রাইজ পেয়েছিস।
দুচোখ দিয়ে জল পড়ছে শ্রেয়সীর। জলে ভেজা গালে মিশে যাচ্ছে নোনতা জলের ধারা। কানে কানে কেউ যেন ফিসফিস করে বললো, মনে রাখিস তুই ইন্দ্রনীল চ্যাটার্জীর বংশধর। গলাটা শ্রেয়সীর ভীষন চেনা। ছোট থেকে এই গলাটাই ওকে বারবার বলেছে, মামনি ভাগ্যিস তুই জন্মেছিলি।
