অন্যন্যা পোদ্দার :- যেদিন শ্বশুরবাড়িতে ঢুকলাম, তার দিন দশ বারো পরেই একটা কান্ড ঘটে গেল | আমি আমার শাশুড়িমায়ের মতামত না নিয়েই নিজের ইচ্ছেতে মশালা ধোসা বানিয়ে নিয়েছিলাম | রাতের রুটি ততক্ষনে হয়ে গেছে | শাশুড়িমা বানিয়ে ফেলেছেন আমি অফিস থেকে ফেরার আগেই | রান্নাঘরের সবটুকু শাশুড়িমায়ের অধিকারে থাকে সবসময়, সেটা আমার বর সৌরভ বিয়ের আগেই আমাকে জানিয়ে বলেছিলো, ” ওই ঘরটা অধিকার করতে যেও না কখনো | ওই রান্নাঘরটা মায়ের নিজস্ব কোম্পানি | ওখানকার প্রেসিডেন্ট, সিইও, চেয়ারম্যান সব মা নিজেই | অতএব রান্না বা রান্নাঘর নিয়ে কখনো নিজের মতামত দেবে না তুমি | ”
যদিও আমার শাশুড়িমা শুধু রান্নাঘর না, গোটা পরিবারেই সিইও হয়ে আছেন, সেটা অন্য ব্যাপার | স্বামী, ছেলে মেয়ে সব কি পরবে, কি খাবে সব কিছুতেই নাক গলিয়ে নিজের মতামত দিতে না পারলে আমার শাশুজির পেটের ভাত হজম হয় না |
যাই হোক, তো বিয়ের পর আমি সেই সিইওর ইগোয় এসে আঘাত করি, অবশ্যই অজান্তে |
বিয়ের দশ বারো দিনের মাথায় অফিস থেকে ফিরে ওই রুটি আর চালকুমড়োর তরকারি দেখে আমার খাওয়ার ইচ্ছেটা প্রায় চলে গিয়েছিলো | রোজ রাত্রে ওই এক রুটি আর তরকারি আমার মুখে রুচতো না | আমি চিরকালই খাদ্যবিলাসী | বেশি খাইনা, কিন্তু গতে ধরা খাওয়াও আমার চলে না | তাই আমি ঠিক করি, আমি মশালা ধোসা খাবো | আমার ধোসা খাওয়ার কথা শুনে সৌরভ বলে বসলো, ” একটু বেশি করে করো তো, আমিও খাবো | ”
এরপর তুলিও যোগ দিলো আমাদের দলে |তুলি সৌরভের একমাত্র ছোট বোন | আমি আমার বৌদির কাছে যতটা আদরের ছিলাম, তুলিও আমার কাছে ঠিক তাই | বয়সের পার্থক্য প্রায় এগারো বারো বছরের, কিন্তু ভালোবাসায় আর বন্ধুত্বে তুলির সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল ভীষণ খাঁটি | আমার বিয়ের আগে ওই বাড়িতে আমি সত্যিই রাজকন্যে ছিলাম | বাবা মা, দাদার আদরের তো ছিলামই, কিন্তু বৌদিমণির যেন চোখের মণি ছিলাম | আমার বৌদিমণির বিয়ের প্রায় বছর পাঁচেক বাদে আমার ভাইপো হয় | কিন্তু প্রথম থেকেই বৌদিমণির প্রথম থেকেই আমায় মায়ের আদর দিতে শুরু করেছিল | বুবুন মানে আমার ভাইপো আমার বৌদির প্রথম সন্তান হলেও বৌদিমনি আমার জন্য প্রথম মা হয়ে উঠেছিল যেন |
তাই তুলিও আমার কাছে সেরকমই বড্ড আদরের | ওই বাড়িতে আমি সবার ছোট এবং আদরের ছিলাম | কিন্তু বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে এসে বড়ো ছেলের বৌ হয়ে গেলাম | সৌরভের থেকে প্রায় বছর তেরোর ছোট তুলি | তাই তুলি আমার কাছে শুধু সম্পর্কে ননদ ছিল, আদতে ছিল আমার ছোট বোন | সেই তুলিও তার দাদাভাই আর বৌদিভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “আমিও তোমাদের সাথে ধোসা খাবো | ”
বাপি শুনে বলল, ” আমিও বা বাদ যাই কেন ?? আমিও তোমাদের সাথে আজ মশালা ধোসা খাবো | ”
বাকি পড়ে রইলেন মামনি | দশচক্রে তিঁনিও ভূত হয়ে সেদিন রাত্রে ধোসা হজম করলেন | রাতের রুটিগুলো পরেরদিন সবাই মিলে তুলে দেবে ঠিক হয়ে রইল |
আমার মনে আছে, পরেরদিনটা শনিবার ছিল | আমার, সৌরভ ও বাপির ছুটির দিন থাকে | ওইদিন তুলিরও কলেজে বিশেষ একটা ক্লাস থাকে না, তাই মাঝে সাঝেই শনিবারে কলেজ ডুব দেয় তুলি | আমি সকালবেলায় রান্নাঘরে যাই | আমার শাশুড়িমায়ের অবশ্য কারোর হেল্প টেল্প লাগে না | আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াই সৌজন্যতার খাতিরে | বৌদিমনি শিখিয়ে পাঠিয়েছে, ” রান্না করিস বা না করিস, ছুটির দিনে রান্নাঘরে ঢুকবি রান্না করতে | শাশুড়ির পাশে দাঁড়াবি, উঁনি যা বলবেন, করে দিবি | ”
বৌদিমনির কথা শুনে সৌরভ হেসে গড়িয়ে পড়েছিল | হাসতে হাসতে বলেছিল, ” তাহলেই হয়েছে | বিন্দি তুমি বিয়ের আগে ডিভোর্স পেপারটা তৈরী করে রেখো | আমি আগেই সই দিয়ে রাখছি | বৌদিমনির কথামতো চললে ও বাড়িতে তুমি খুব বেশিদিন টিকতে পারবে না | রান্নাঘরটা মায়ের কাছে সিংহাসনের মতো | ওইটা কোনোভাবেই হাতছাড়া করবে না মা |”
বৌদিমণি তাও বলেছিল, “সৌরভ যা বলার বলুক | তবুও তুই গিয়ে দাঁড়াবি উঁনার পাশে | ”
বৌদিমণির হুকুম, অমান্য করতে পারি না আমি | এই হুকুম আমার মা করলেও বোধহয় অবজ্ঞা করতাম আমি | কিন্তু বৌদিমণির কোনো কথাই আমার কাছে ফেলনা নয়, তাই ছুটির দিনে শাশুড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম |
শাশুড়িমা বেশ গম্ভীর মুখে শুরু করলেন, ” তোমাকে একটা কথা বলি, বিন্দি | মন দিয়ে শোনো | ”
আমি বুঝলাম, এবার একটা বোমা পড়বে | কিন্তু বোমা পড়ার কারণটা অনুধাবন করতে পারলাম না বলে তাকিয়ে থাকলাম তার মুখের দিকে | তিনি তখন বলে চলেছেন, ” এটা তো তোমার বাড়ি নয়, এটা তোমার শ্বশুরবাড়ি | এই বাড়ির কিছু নিয়ম নিষ্ঠা আছে, কিছু আদব কায়দা আছে, সেগুলো তোমাকে মেনে চলতে হবে | ”
আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, আমি ঠিক কিরকমভাবে আমার শ্বশুরবাড়ির রীতিতে আঘাত হেনেছি | তবে একটা কথা খুব কানে লাগলো, ” এটা তো তোমার শ্বশুরবাড়ি !! ”
রাগ হয়নি আমার তাঁর কথায় | তবে উটকো কথা কানে এলে একটু অস্বস্তি হয় আমার, আর ছোটবেলা থেকে আমি প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই ঠোঁটকাটা | আমার এই ঠোঁটকাটা স্বভাব বৌদিমণির কানমলা খেয়েও কমেনি, সারা তো অনেক দূরের ব্যাপার !!
সেই ঠোঁটকাটা স্বভাবের জেরেই বলে বসলাম, ” কিন্তু মামনি, সৌরভ যে বলছিলো, এই বাড়িটা নাকি ওর দাদুর করা | ”
— ” হ্যাঁ, তাতে কি ?? ”
— ” তাহলে এই বাড়িটা তো আমার একার শ্বশুরবাড়ি নয়, তোমারও শ্বশুরবাড়ি | শুধু ‘ তোমার শ্বশুরবাড়ি ‘ না বলে ‘ আমাদের শ্বশুরবাড়ি’ বললে বেশ শুনতে লাগে, একটা অন্যরকম ফিলিংস হয়, আর কি !! আফটার অল, আমরা দুজনেই তো বাইরে থেকে এসেছি | তাই তোমার আমার অবস্থানটা এক করে রাখলে আমরাই প্রফিটে থাকবো বেশি | ”
আমার শাশুমার কড়াইয়ে নাড়তে থাকা খুন্তি থমকে গেল কড়াইয়ের মধ্যেই | বুঝলাম, আমার কথাটা আমি আমার শাশুড়িমায়ের মস্তিস্ক অব্দি পৌঁছিয়ে দিতে পেরেছি | তিনি সে প্রসঙ্গ ছেড়ে একেবারে সোজাসুজি বলে বসলেন এবার, ” এই যে, কাল রাত্রে যেটা করেছো, আর করবে না | আমি সবার শরীর স্বাস্থ্যর কথা ভেবে রান্না করি | তাই নিয়ম করে রাত্রে রুটি তরকারি বানাই সবার জন্য | এটাই এই বাড়ির নিয়ম | তোমার যদি রুটিতে রুচি না আসে, তাহলেই একা বাইরে থেকে খেয়ে আসবে | বাড়িতে এসে ওইসব উৎপটাং রান্না করে আমার বাড়ির নিয়ম ভঙ্গ করবে না | বিয়ে হয়ে এসেছো, এগুলো এখন তোমার শেখা উচিত | ”
বুঝলাম, ম্যাডামের আঁতে খুব লেগেছে !! আসলে আমার শাশুড়িমা বৌভাতের পরেরদিনই বুঝে গিয়েছিলেন, রান্নাঘরে আমায় ঢুকতে দিলে উঁনার এতবড়ো সাম্রাজ্য হাতছাড়া হতে খুব বেশি সময় লাগবে না | বিয়ের আগে যদি উঁনি জানতেন, যে, আমি খুব ভালো রান্না করি, তাহলে কোনোকালেই বোধহয় আমায় সৌরভের বৌ হতে দিতেন না | আমি পেশায় চাটার্ড একাউন্টেন্ট হলেও দারুন রান্না করতে পারি | বৌদিমণির সঙ্গ পেতে রান্নাঘরে প্রচুর সময় কেটেছে আমার | রান্নাতে আগ্রহও ছিল, তাই রান্নাটা জব্বর করি আমি !! হেন কোনো রান্না নেই, যেটা আমি পারি না | তবে আমার এই গুণটার কথা খুব যত্ন করে নিজের মায়ের কাছে লুকিয়ে গিয়েছিলো সৌরভ | কারণ, সৌরভের মা রান্নাটা উদর পূর্তির জন্য করেন, ভালোবেসে করেন না | ফলে তোয়াজটা থাকে না বলে সে রান্নায় স্বাদও থাকে কম | সৌরভ আমার প্রেমেও পড়েছিল আমার হাতের তৈরী রান্না খেয়ে | আমাদের এক কমন ফ্রেন্ডের বাড়িতে আমি এক রাত্রে ফিস ফ্রাই আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ান করেছিলাম | ফিস ফ্রাইয়ে কামড় বসিয়েই সৌরভ আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, ” আপনি কি এনগেজড ?? নাকি সিঙ্গেল আছেন এখনও ?? ”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ” কেন বলুন তো ?? ”
— ” না, যদি সিঙ্গেল থাকেন, তাহলে আমায় বিয়ে করুন প্লিজ | আমি আপনার হাতের রান্নার প্রেমে পড়ে গেছি !! ”
আমি, আমার সেই বন্ধু দুজনেই হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষনের জন্য | ছেলেরা তো মেয়েদের চোখে, ঠোঁটে, হাসিতে, মুখের কোনো নির্দিষ্ট তিলে বা এক ঢাল চুলের প্রেমে পড়ে | এ আবার আমার রান্নার প্রেমে পড়ে গেল !!
সেদিন কিছু না বললেও পরে অবশ্য আমিও সৌরভের প্রেমে পড়ে যাই, ওর ট্যালেন্ট দেখে | কলকাতার হাই কোর্টে তো বটেই, দিল্লীর হাই কোর্টেও বহু কেস জিতে এসেছে সৌরভ !! আইনি দুনিয়ায় ক্রিমিনাল ল ইয়ার হিসেবে খুব অল্প বয়সেই খুব বেশি নাম করে ফেলেছে ও !!
সেই আমি বিয়ের পরেরদিন সুজির পায়েস বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়ে ছিলাম | আমার শাশুড়িমা জানতেন না, আমি এত ভালো রান্না করতে পারি | উঁনি ভেবে ছিলেন, চাটার্ড একাউন্ট পড়তে গিয়ে সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজেই বসে থেকেছে এই মেয়ে !! বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ছোট, এত আদরের, জল গড়িয়ে খেতে জানে না !! অতএব এ আর কি রান্না করবে | কিন্তু শাশুমা সেই প্রবাদবাক্যটা ভুলে গিয়েছিলেন, ” যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে ” | ফলে খুব কনফিডেনসের সাথে নিজের সাম্রাজ্যে শাসন করতে পাঠিয়ে ছিলেন আমায় | ব্যস, সবাই আমার হাতে খেয়ে একেবারে মুগ্ধ !! তারপর থেকেই শাশুমা আর আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেন না | বাড়ির অন্য কোনো কাজ যদিও বা করতে দেন, রান্নাঘরের কিচ্ছুটিতে হাত লাগাতে দেন না আমায় | ভাবখানা এমন রাখেন, “খাও দাও, অফিস করো | আমার সংসারে নাক গলাবে না | “….
সেই সংসারেই নাক গলিয়ে বসলাম আমি | আমি বুঝলাম, কালকের মশালা ধোসাটা যে চরম হয়েছিল খেতে, সেটার জন্যই শাশুজির এই হাল্কা হুমকি | বিশেষ করে বাপির একটি কথা, ” মাঝে সাঝে একরম কিছু জিনিস করিয়ে খাইয়ে তো বিন্দি | মুখটা বদলাবে তাহলে | “… মামনিকে মসনদ হারাবার ভয় পাইয়ে দিয়েছে বেশ ভালো করেই | তাই এই ধরণের গোলা বর্ষণ করা হচ্ছে আমার উপরে |
আমি আর কথা বাড়ালাম না | বুঝলাম, জীবনে কোথাও নিজের গুরুত্ব না পাওয়া মানুষটা সংসারে গলার জোরে, গায়ের জোরে, ইগোর জোরে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে সংসারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চান | কিন্তু বাড়ির সবাই হা পিত্যেস করে থাকে আমার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য | কিন্তু মামনি কিছুতেই আমাকে রান্না করতে দেবে না |
তাই ক্রিমিনাল ল-ইয়ার ঠিক করলেন, মাঝে মধ্যে তিনি, বাপি আর তুলিকে নিয়ে আমাদের এই বাড়িতে চলে আসবেন | আমি রান্না করবো, তারা খাবেন | তারপর যে যার মতো বাড়ি ঢুকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলে দেবে | মায়ের ইগো আর ইমোশনকে বজায় রাখতে কিছু রাতের রুটি পরেরদিন রাস্তার কুকুরের পেটে যেত | বাপি মজা করে বলতো, ” এটাও তো পুণ্য হচ্ছে একরকম | ”
এর বেশ কিছু মাস পরে একদিন রবিবার করে কড়াইয়ে মাংস কষাচ্ছিলো মামনি | সেদিন কেন জানিনা, থালার মধ্যে দুপিস মাংস, একপিস আলু আর একটু মশলা তুলে ফ্রিজ থেকে আগেরদিনের ভাত মাইক্রোওভানে গরম করে মামনির সামনে দাঁড়িয়েই খেতে শুরু করলাম | খেতে খেতে বললাম, ” মামনি, ভালোই হয়েছে বেশ, তবে একটু ঝাল আর আর একটু নুন দিলে আরও জমে যাবে | আর যদি গরম মশলার গুঁড়োটা এখনই কষানোর সময় দাও, তাহলে একটা আলাদা ফ্লেভার আসবে | ”
বলেছিলাম বটে, তবে জানতাম মামনি মোটেও আমার কথা শুনবে না | কিন্তু সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে মামনি শুনেছিল আমার কথা | আর দুপুরবেলা খেতে বসে সেদিন মামনি প্রশংসাও কুড়িয়ে ছিল প্রচুর | কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিলো না, যে মাংসটা মামনির করা !!
বাপি তো আলাদা ভাবেই জিজ্ঞেস করে বসলো আমায়, ” তোমার মামনিই করেছে তো রান্নাটা ?? নুন, ঝাল এতটা ঠিক করলো কি করে ?? ”
আমি বাপি বা বাড়ির আর কাউকে জানতে দিইনি সেদিন, যে, মাংসের নুন ঝোলটা আমিই টেস্ট করে সঠিক মাপটা বলে দিয়েছিলাম |
এরপর থেকে প্রতি রবিবার মাংস রান্নার আগেই ডাক পড়তো আমার, চুপিচুপি মাংসের ঝোলের নুন ঝাল টেস্ট করতে | এক রবিবারে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকতে দেরী হয়েছিল বলে বেশ কড়া গলায় বলে উঠেছিলেন, ” সংসারের কিছুই তো করতে হয় না | একদিন রবিবার, তাও সকালবেলায় এসে রান্নাঘরে একটু দাঁড়ানো যায় না নাকি !! ”
আমি বুঝতে পারছিলাম, মুখে না বললেও আমার শাশুমা তাঁর রান্নায় আমার সহযোগিতা চাইছিলেন | আমিও না বোঝার ভান করে রান্নার টুকিটাকি টিপস দিতাম | ‘এটা করো’, ‘এটা দাও’ বলতাম না | বলতাম, এই পদে এটা করলে বা এটা দিলে রান্নায় আরও স্বাদ বাড়ে | রবিবারের দুপুরের ডাইনিং টেবিল মায়ের হাতের রান্নাতেই জমে উঠতে শুরু করলো | দেখলাম, রাতের রোজকার রুটি তরকারি বদলে মাঝে সাঝে রান্নায় ব্যতিক্রমী পদ রাতের খাবারে যোগ হতে থাকলো | বাড়ির নতুন নিয়ম হোলো, সবাই টেবিলে বসে একসাথে গরম গরম খাবার খাবে, একেবারে ধোঁয়া ওঠা গরম | তাই আমি অফিস থেকে ফেরার পরে রান্না হতে শুরু করলো, এবং নিয়ম করে আমাকে আমার শাশুমার পাশে দাঁড়াতে হোলো | আমার কাজ শুধু ওইটুকুই — রান্নার নুন, ঝাল ঠিক করে চেখে বলে দেওয়া !!
রান্নার পদের মতো জীবনের সম্পর্কগুলোও একটু নমকিন হওয়া উচিত | নোনতা নোনতা তবে একেবারে নুনকটা নয় | তবেই বোধহয় সম্পর্কগুলো বেশি গ্রহণযোগ্য হয় | মামনি রান্না ভালোই করতো, শুধু নুন ঝাল টুকুর সঠিক পরিমানটা ধরতে পারতো না বলে জোর করে, ভয় পাইয়ে সংসার সাম্রাজ্যের অধিকারটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করতো | অনেক পরে হলেও জীবনের এই নমকিন স্বাদটা মামনি উপলব্ধি করতে পারে, আর এটাও বুঝতে পারে, আমি খুব ভালো রান্না করলেও মামনির মসনদ কেড়ে নেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই | তাই মুখ ফুটে কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করলেও শারীরিক ভঙ্গিমায় এবং বাড়ির নিয়ম অনুসারে তিনি আমাকে রোজ রান্নাঘরে চান |
মানুষের পেটকে তৃপ্ত করতে পারলে যে তাঁর মনকেও বশে আনা যায়, এটা মামনি বুঝে যাওয়ার পরে বাড়ির সবার বাইরে নিমন্ত্রণ পাওয়ার সংখ্যা কমে যায়, বলা যায় একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়, মানে, আমার বাড়িতে বসে আমার হাতের রান্না চুপিচুপি খাওয়ার পরিকল্পনাটা সংখ্যায় কমতে থাকে | বাপির মতে, ” তোদের মা যখন ভালো ভালো রান্না করছেই, তখন বিন্দিকে খাটিয়ে কি হবে আর | ”
বাড়িতে সবার উপরে মামনির শাসন এখন অনেক কম হয়ে গেছে | এখন শাসন চলে শুধু আমার উপরে | সঠিক সময়ে রান্নাঘরে আমাকে না পেলেই চিৎকার শুরু হয়ে যায় তাঁর | ওই, আবার চিৎকার শুরু হয়েছে | এবার উঠি, আরেকদিন গল্প করবো আপনাদের সাথে | আজ রাত্রে এঁচোড়ের কোপ্তা হবে | নুন ঝাল টেস্ট করতে হবে তো | আই এয়াম টেস্টার আফটার অল !!