Select Language

[gtranslate]
২৮শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বৃহস্পতিবার ( ১৩ই মার্চ, ২০২৫ )

।। সমীকরণ ।।

পল্লবী মুখার্জী :- প্রতিমা দেবী তাড়া দিচ্ছেন তৃণা কে, ” তাড়াতাড়ি করো বৌমা, কতোদিন বাদে পল্টু আসবে, বড়ো বৌমা আসবে আমার দাদুভাই আসবে”…

তৃণা হাসে, শরীরে অশক্ত মানুষটা মনে মনে ছটফট করছেন, হাতে পায়ে জোর থাকলে নিজেই সবটা করে ফেলতেন…..তৃণা যদিও সবটাই করছে তবুও ওনার অস্থিরতা কমছে না…..

আজ তৃণা আর অসীমের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী….দুজনেই অফিস ছুটি নিয়েছে, তবে ওদের নিজেদের ব্যস্ততার থেকেও বেশি ব্যস্ত এতদিন পরে দাদা বৌদি আসছে বলে…ছোট্ট তুতান কে দুজনেই মিস করে…তবে তৃণার বুক ধড়ফড় করছে, কেউ জানেনা, শুধু ও জানে ওর জন্যই ওর ভাশুর আজ ট্রান্সফার নিয়ে সুদূর মুম্বাই এর বাসিন্দা হয়েছে….তবে দোষ কি শুধু তৃণার একার??? মন যে কখন কোন জটিল পথের আঁকা বাঁকা গলিতে হারিয়ে যায় তার ঠিকানা শুধু সেই জানে…. মাংস টা ম্যারিনেট করতে করতে এক বছর আগের কিছু ঘটনায় হারিয়ে গেলো তৃণা….

এক বছর আগে সমন্ধ করেই অসীম আর ওর বিয়েটা হয়েছিলো….অসীম রাজ্য সরকারের ইলেক্ট্রিসিটি বিভাগের কর্মচারী, তৃণা একটি স্কুলের শিক্ষিকা, শোভাবাজার এর দিকে ওর স্কুল, তবে বিয়েটা হোলো দক্ষিণ কলকাতায়….ওর ভাশুর মানে অসীমের দাদা তুহিন সল্ট লেক আই.টি সেক্টরে উচ্চ পদে কর্মরত….বাড়িতে লোক বলতে তৃণার শাশুড়ি, বড়ো ভাশুর, বড়ো জা, ছোট্ট তুতান, অসীম আর সদ্য বিবাহিতা তৃণা….

শাশুড়ি ,জা দুজনকেই বেশ ভালোমানুষ বলে মনে হয়েছিলো তৃণার, শাশুড়ি অকারণ খুঁত না ধরে সংসারটি বড়ো বৌমার হাতে তুলে দিয়েই নিশ্চিন্ত, নিজে যতোটা পারেন সাহায্য করেন…কদিনেই বেশ সহজ স্বাভাবিক হয়ে এদের সাথে মিশে গেছিলো তৃণা….

বিয়ের দিন দশেক পরে আবার স্কুলে যোগদানের দিনটা বেশ মনে পড়ে তৃণার, দশটার দিকে তৈরি হয়ে ভাবছিলো কিভাবে যাবে, বাসে যাওয়া যায়, তবে শাড়ি পরে বাসে ওঠা বিশেষ অভ্যেস নেই, যদিও এখানে পোশাক নিয়ে কেউ কিছুই বলে না , তবুও বিয়ের পরে পরেই চুড়িদার পরে স্কুলে যেতে মন চায়নি তৃণার….

অসীম সাফ বলে দিলো, ” তোমাকে স্কুলে দিয়ে তারপর আমাকে অফিসে যেতে হবে?? ওবাবা, পুরো উল্টো রাস্তা, একবার গিয়ে আবার ফেরৎ এসে আবার যাওয়া….”

তৃণার ও খারাপ লাগছে, সত্যিই তো ওর জন্য অসীম কে অনেকটা ঘুরতে হবে, সমাধান করেছিলেন ওর বড়ো জা, ” তুই তুতান এর বাবার গাড়িতে চলে যা না, ওই পথেই তো যাবে, তোকে নামিয়ে দেবে”….

সেই শুরু বড়ো ভাশুরের গাড়িতে যাওয়া…. ভাশুর শব্দ টা শুনতে গম্ভীর হলেও তুহিন অসীমের থেকে মাত্র চার বছরের বড়ো……বেশ হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মানুষ….গাড়িতে তো আর চুপ চাপ বসে থাকা যায় না, তাই ভাইয়ের বউয়ের সাথে অল্প বিস্তর গল্প করতে করতেই যাচ্ছিলো তুহিন…. তৃণা ও নানারকম গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছিলো…

ধীরে ধীরে এই গল্প করাটাই বেশ উপভোগ করতো দুজনে, আজকের দিনে ভাশুর, ভাইয়ের বউ এই সম্পর্কের বাইরেও বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছিলো দুজনের…..আসলে গতানুগতিক সংসারে তুহিন যেনো এক টুকরো খোলা হাওয়ার সন্ধান পেয়েছিলো তৃণার মধ্যে….তৃণার ও ভালো লাগতো এই সঙ্গটুকু…. মাঝে মাঝেই দুজনে শপিং মলে নানারকম জিনিস বা খাবার কিনে নিয়ে ফিরতো, বাড়ির সকলের জন্যই কিনতো কিন্তু অসীম বা ওর বড়ো জা কে নিয়ে আসার কথা মাথায় আসেনি কোনোদিন….

মাস দুয়েক পরে তৃণা নিজেই বুঝতে পারছিলো সম্পর্কে দ্বিচারিতা করে ফেলছে সে, আচ্ছা তুহিন ও কি এমনটাই ভাবে?? নাকি তৃণা শুধুই ওর কাছে ভাইয়ের বউ?? মরমে মরে যাচ্ছে সে, মাত্র দু মাস বিয়ে হয়েছে, অসীম খুবই ভালোমানুষ, আর দিদিভাই?? তার তো তুলনাই হয় না…দুটো নিরীহ, সহজ সরল মানুষকে ঠকানোর কোনো অধিকার আছে কি ওর?? আর তুতান?? সে কিভাবে চিনবে তার বাবাকে?? না ,না, অন্য কোনো সম্পর্ক ঘনীভূত হওয়ার আগেই তৃণাকে বেরোতে হবে এই অভ্যেস থেকে…

অসীম কেও সে খুব ভালোবাসে, দুটো সংসার এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না….পরদিন জোর করেই অসীম কে বলেছিলো, ” আমাকে তুমি স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসবে চলো”…

হেসে, বউয়ের থুতনি নেড়ে অনুরাগের সুরে অসীম বলেছিলো, ” বরের অদর্শন সহ্য হচ্ছে না বুঝি?? বেশ তো বাবা এসি গাড়িতে যাচ্ছ, আসছো, সুখে থাকতে ভূতে কিল মারছে নাকি?? আমি পারবো না দিয়ে আসতে”….

গলার কাছটা কান্নায় বুজে আসছিলো তৃণার, কি অসম্ভব সরল মনের মানুষ এই লোক টা, একটুও সন্দেহ হয় না?? আর দিদিভাই?? সে তো মেয়ে, তার কোনরকম অস্বাভাবিক মনে হয় না কিছু?? নাকি তুহিনের সত্যিই কোনো দুর্বলতা নেই তৃণার প্রতি??

আজ ফেরার পথে তুহিন আর তৃণা দুজনেই বেশ চুপ চাপ, আসলে অন্যদিন তৃণা শুরু করে স্কুলের গল্প, আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, মনটা বেশ ভারাক্রান্ত, এমনটা সে চায়নি, বিয়ের পর মন দিয়ে অসীমের সাথেই সংসারটা করতে চেয়েছিলো…আর তার পক্ষে অসীম কে ছাড়াও সম্ভব নয়….. গাড়িটা থামতেই সম্বিত ফিরে পেলো সে, এটা তো বাড়ি নয়?? এটা একটা পার্ক, অনেকেই সকাল সন্ধ্যা হাঁটতে আসে এখানে….কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নামলো তুহিন, পিছন পিছন তৃণা…

” দ্যাখো তৃণা, আমি সোজা কথা সোজা ভাবেই বলতে পছন্দ করি, তাতে সমস্যার সমাধান হয় তাড়াতাড়ি….তুমিও বুঝতে পারছো আর আমিও বুঝতে পারছি আমাদের সম্পর্ক টা শুধুই ভাসুর আর ভাইয়ের বউ এতে থেমে নেই….আমরা দুজনে দুজনের সঙ্গ উপভোগ করি, ভালো লাগে একসাথে সময় কাটাতে….কিন্তু আমি জানি আমি শুভ্রা কে কতটা ভালোবাসি, তুতান কে ছাড়ার কথা ভাবতেও পারি না….তুমিও যে অসীম কে ভালোবাসো সেটাও আমি বুঝি…..অন্তর্দ্বন্দ্বে তুমি, আমি দুজনেই ভুগছি….তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মায়ের একটু কষ্ট হবে, তবে তুমি আর ভাই ম্যানেজ করো….মুম্বাই এর একটা প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে আমি বদলি চেয়েছি, মনে হচ্ছে মাসখানেকের মধ্যে হয়ে যাবে, আসবো আমরা মাঝে মধ্যে…. তোমারও নতুন সংসার, দেখবে অসীমের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগবে…..আমার বিশ্বাস আমার মতো তুমিও কাউকে ঠকাতে চাও না”…

মন থেকে বোঝাটা নেমে গেছিলো তৃণার….খুব খুশি হয়েছিলো, এটাই ভালো হোলো, অভ্যেস আসতে আসতে নষ্ট হয়ে গেলেই সংসারেও মন বসবে ওর…..দরজায় বেল বাজাতেই বাস্তবে ফিরে এলো তৃণা…..বিগত সাত মাসে একবারও আসেনি ওরা, দিদিভাই যদিও রোজ ফোন করে, তবে ইচ্ছে করেই তুহিনের সাথে কথা বলে না তৃণা…অসীম যে ওকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছে….

তুতান দৌড়ে এসে কাকিমনি কে জড়িয়ে ধরলো…বড়ো জা অনর্গল বক বক করে চলেছে….. এতোদিন প্রতিমা দেবী যেনো হাসতেই ভুলে গেছিলেন, আজ ওনাকে অনেক সুস্থ দেখাচ্ছে….তৃণা একবার ভাবলো বলে তুহিন কে, আপনারা ফিরে আসুন এখানে, পরে নিজেই মন কে শক্ত করলো, দূরে আছে বলেই হয়তো ভালো মনের মানুষ হয়ে আছে দুজনে, কাছে এলেই মনের মন্দ দিক উঁকি দেবে, নিষিদ্ধ সম্পর্কের হাতছানি দেবে প্রবল ভাবে…..তার থেকে এই ভালো, একটু কষ্টের বিনিময়ে দুটো সংসার বেঁচে যাওয়া, সম্পর্ক গুলো স্বাভাবিক থাকা…. খারাপ ভাবনা গুলোকে সরিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো তৃণা, বড়ো জায়ের পছন্দের মসলা কুলচা বানিয়েছে ও, গরম গরম পরিবেশন করতে হবে…

Related News