অমিত রায়:-বিষাদের সুর আকাশে বাতাসে চারিদিকে বয়ে যাচ্ছে কারন মা দুর্গা বছরে পাঁচটি দিন বাপের বাড়ী এসে সবার মনে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিয়ে আবার সকলকে কাঁদিয়ে কৈলাসের পথে রওনা দেওয়ার জন্য। আর এর মাঝে মুখার্জি বাড়ীতে চলছে চরম অশান্তি।
কারন বাড়ীর বৌমা ইন্দ্রানী গেলো দিন নবমীর রাতে ঠাকুর দেখার সময় ছিনতাইকারীরা তার কাছ থেকে সোনার গহনা জোর করে নিয়ে যায়। আর এই নিয়ে স্বামী সুমিতের সাথে ইন্দ্রানীর চলে খুব মন কষাকষি৷ শ্বাশুড়িও প্রচন্ড রেগে যায় ইন্দ্রানীর উপর। কারন ইন্দ্রানী কে বারন করা স্বত্বেও সোনার গহনা পরে ঠাকুর দেখতে বের হওয়ায় এই পরিস্থিতি।
আসলে ষষ্ঠী থেকে অষ্টমী পর্যন্ত ইন্দ্রানী ঠাকুর দেখতে বের হয়নি কারন সোনার গহনা। ইন্দ্রানী ছিলো একটু স্বাধীনচেতা। নিজের মন যা বলে সেটাই করে ইন্দ্রানী তবুও মন ছিলো তার পরিস্কার। তবুও শ্বাশুড়ি ইন্দ্রানীকে তেমন ভালো চোখে দেখতোনা।
আর ইন্দ্রানী মা না হতে পারার জন্য শ্বশুরবাড়ি লোকেরাও ছিলো একটু তার উপর অখুশী। তাই তো ইন্দ্রানী মনে মনে কষ্ট পেতো। তাই এবার পুজোতে ইন্দ্রানীর ইচ্ছে হয় সোনার গহনা পরে মায়ের মুখ দেখবে আর নিজে মা হওয়ার প্রার্থনা করবে। কিন্তু আপত্তি শ্বশুরবাড়ীর সবার কারন কেউ ইন্দ্রানীকে এতো ভিড়ের মাঝে সোনার গহনা পরে ঠাকুর দেখতে দেবেনা। যার কারনে অভিমান করে ইন্দ্রানী অষ্টমীর দিনও অঞ্জলি দেয়নি। যদিও ইন্দ্রানী জেদি আর ছেলেমানুষী স্বভাবের তবুও তার ছিলো দয়ার শরীর।
তাইতো যে কাজ মন থেকে সাড়া দেয় সেটা করতে বেশী পছন্দ করতো। যুক্তিসংগত কর্ম করতে ইন্দ্রানী সর্বদা পছন্দ করতো। তাইতো সুমিতের কাছে তার বক্তব্য ছিলো বছরে একটি দিন মায়ের দর্শন করবে সোনার গহনা পরে অন্য কিছু নয়। কিন্তু সুমিত ও ইন্দ্রানীর শ্বাশুড়ির সাফ কথা প্রতিমা দর্শন করতে গেলে ইমিটেশন বা অন্যকিছু পরে যেতে হবে। আর সোনা যদি পরতেই হয় তাহলে গলায় মঙ্গলসুত্রটা তো আছে! তাহলে আবার সোনা কেন পরতে হবে! আর এই নিয়েই সুমিত আর ইন্দ্রানীর মাঝে চলে গোলযোগ। এরপর নবমীর দিন সকালে ইন্দ্রানীর বান্ধবী মাধবী ফোন করে ইন্দ্রানীকে সুমিতকে নিয়ে প্রতিমা দেখতে যেতে অনুরোধ করে।
ইন্দ্রানী তখন মাধবীকে রেগে বলে ঠাকুর দেখতে গেলে যাবো তোর সাথে কিন্তু সুমিতের সাথে নয় আর সোনার গয়না পরে যাবো তাতে যা হয় হবে। এরপর রাতে মাধবীকে নিয়ে ইন্দ্রানী ঠাকুর দেখতে বের হয়। অনেক গুলো ঠাকুর দেখার পর রাত দশটা বেজে গেলে বাড়ী ফেরার সময় পথের মাঝে তিন চারটে মোটর বাইক এসে ইন্দ্রানীকে ছুরি দেখিয়ে গলা থেকে সোনার গয়না নিয়ে যায়। কিন্তু ইন্দ্রানীর অনুরোধে ছিনতাইকারীরা মঙ্গলসুত্রটি নেয়নি। এমন সব কাহিনী বলে শ্বশুরবাড়ী ইন্দ্রানী। আর সবকিছু শোনবার পর সুমিত ও শ্বশুর শ্বাশুড়ি আরও ক্ষেপে যায়। শ্বাশুড়ি বলে আমার কথা শুনলে আজ এমন হতোনা।
সুমিত বলে আমি যে স্বামী সেটা তো কেউ মানেনা। আর তাই যদি হতো তাহলে আমার কথা শুনলে আজ কপাল পুড়তোনা। এখন বোঝো কেমন লাগে! এরপর সুমিত বলে এমনিতেই তো একটা সন্তান দিতে পারোনি তারপর আবার কিসের এতো জেদ! এগুলো শুনে চুপ থাকে ইন্দ্রানী। এরপর দুপুরে খাওয়ার পর ঘরে গেলে সুমিতকে ইন্দ্রানী বলে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। সুমিত বলে কি আর কথা শুনবো। তখন ইন্দ্রানী বলে না আজ তোমায় কিছু শুনতে হবে না হলে আমার বিবেক কেমন যেন শান্তি পাচ্ছেনা। এরপর ইন্দ্রানী বলে আসলে আমি কিছু মিথ্যা বলেছি। গেলো রাতে আমার কোন সোনার গহনা ছিনতাই হয়নি বরং ওটা আমি অন্য কাজে লাগিয়েছি। তখন সুমিত বলে মানে কি বলছো! আমি কিছুই তো বুঝতে পারছিনা।

ইন্দ্রানী তখন বলে আমি তোমাকে না বলে সোনা পরে ঠাকুর দেখতে গিয়ে ভেবেছিলাম আমি আর বাড়ি ফিরবোনা। কিন্তু আমার সব ধারনা পাল্টে দিলো ওই পাঁচ বছরের একরত্তি মেয়েটি যার নাম ফুলকী। তখন সুমিত বলে কে ফুলকী? ইন্দ্রানী তখন আসল ঘটনা বলতে শুরু করে। ইন্দ্রানী বলে আমি মন্ডবে ঠাকুর দর্শনের সময় হঠাৎ অনুভব করি কেউ যেন আমার পা ধরে টানছে। ইন্দ্রানী তখন বলে আমি দেখি একটি পাঁচ বছরের মেয়ে ফুলকী আমার পা ধরে কেঁদে কেঁদে বলছে, আমায় কিছু টাকা ভিক্ষা দাওনা গো, আমার মায়ের টিউমার অপারেশন করতে অনেক পয়সা লাগবে না হলে মাকে বাঁচানো যাবেনা। ফুলকী কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে আমার বাবা নেই। মা আমার সব। আমার মায়ের যদি অপারেশনের টাকা যোগাড় না হয় তাহলে আমার মা মারা যাবে। ইন্দ্রানী তখন সুমিতকে বলে কথাগুলো শুনে আমি আর সহ্য করতে না পেরে নিজের সোনার গহনা সব ফুলকীকে দিয়ে বলি এগুলো নিয়ে যে টাকা হয় সেটা দিয়ে তোমার মায়ের অপারেশন করাও। শুধুমাত্র মঙ্গলসুত্রটা দিইনি। আমি বাড়ী এসে তোমাদের এগুলো বললে হয়তো তোমরা আমায় বকাবকি করবে তাইতো আমি মিথ্যা বলেছি যে, আমার গহনাগুলো ছিনতাইকারীরা নিয়ে গেছে।
আসলে আমি ভেবেছি সবাই যখন এই নবমীতে মন ভরে আনন্দ উল্লাস করছে আর তার মাঝে মায়ের অপারেশনের জন্য ফুলকী এমন ভাবে সবার কাছে হাত পাতছে। আর তাই ওর কষ্ট দেখে আমি আমার চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। আর তখন মনে মনে ঠিক করে ফেলি যে আমার গহনাগুলো দিলে যদি ওর কিছুটা উপকার হয় তাহলে আমি তাই করবো। তাই আমি এমন করেছি। ইন্দ্রানী তখন সুমিতকে বলে সব কিছু শুনে এবার তুমি আমায় যা খুশি বলতে পারো বা আমায় সাজা দিতে পারো তাতে আমি কিছু মনে করবোনা। কারন আমার যা মনে হয়েছে আমি তাই করেছি। কথাগুলো শুনে সুমিত কিছু সময় চুপ থাকে।
এরপর সুমিত বলে আমার আর কিছু বলার নেই। এতোদিন আমি তোমায় কতো কিছু বলেছি যে তুমি বাঁজা, তোমার কোন গুন নেই আরও কতো কিছু। কিন্তু আজ আমি সত্যি খুব গর্বিত যে তোমার মতো এতো বড়ো মনের একজন নারী আমার সহধর্মিণী আর আমি জীবনসঙ্গী। এতো দয়া তোমার শরীরে সত্যি আমি বুঝতে পারিনি। আমায় ইন্দ্রানী তুমি ক্ষমা করো। সুমিত তখন বলে আমার সন্তান না হলেও আমার আজ থেকে কোন দুঃখ নেই কারন আমি যে তোমার স্বামী হতে পেরে ধন্য।
ইন্দ্রানী তখন সুমিতকে বললো না গো আমাকেও তুমি ক্ষমা করো আমিও যে তোমার অনেক কথা শুনিনি। সুমিত বললো তুমি আমার কথা শোননি বলেই তো মহামায়া তোমায় দিয়ে একটি মেয়ের মায়ের অপারেশনের জন্য কিছু করিয়ে নিতে পারলো। তুমি তো অছিলা। তাইতো আমি মহামায়ার কাছে বলবো তুমি পরজন্মেও যেন আমার ইন্দ্রানী হয়ে থেকো। এরপর বিকেলে মা দুর্গাকে সিঁদুর পরানোর জন্য মন্দিরে যায় সুমিত আর ইন্দ্রানী দুজনে। সিঁদুর পরাতে গিয়ে মা দুর্গার কাছে ইন্দ্রানী সবার মঙ্গল কামনা করে যখন সিঁদুর পরিয়ে নীচে নামতে যাবে ঠিক এই সময় হঠাৎ ইন্দ্রানী মাথা ঘুরে পড়ে যায়। সাথে সাথে ইন্দ্রানীকে সবাই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। আর ডাক্তার তখন সুমিতকে বলে অলৌকিক হলেও এটাই সত্য যে আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন। সুমিত তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে ওঠে সবই মহামায়ার ইচ্ছে। আর মুখার্জি পরিবারে এই খবরে খুশির জোয়ার বইতে লাগে। আসলে মানুষকে ভালোবাসলে যে ঈশ্বরও খুশি হয়ে তার মনের বাসনা পূর্ন করে।
তাইতো মা দুর্গা কৈলাসে যাওয়ার আগে ইন্দ্রানীকে দিয়ে যায় মা হওয়ার পরম সুখের অপার আশীর্বাদ। পরিশেষে দশমী মানে শুধু বিষাদ বা কষ্ট নয় বরং আসছে বছর আবার হবে এই ভালোলাগায় মহামায়ার কাছে সকলের হোক আনন্দঘন হাসিমুখ মিশ্রিত প্রার্থনা ।।
সৌজন্যে – প্রতিলিপি






