Select Language

[gtranslate]
১২ই পৌষ, ১৪৩১ শুক্রবার ( ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ )

ভারতীয় ফুটবলের জনক ও ক্লাব ফুটবলেরও পথিকৃৎ নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে প্রনাম ।।

১৮৭৭ সাল। ফোর্ট উইলিয়ামের পাশ দিয়ে বিশাল কালো গাড়িখানা যাচ্ছে গঙ্গার ঘাটের দিকে। কলকাতার বিখ্যাত সর্বাধিকারী পরিবারের গিন্নিমা হেমলতা দেবী তাঁর পঞ্চম পুত্র নগেনকে নিয়ে বেরিয়েছেন গঙ্গাস্নানে। সেই সময়ে ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে ‘ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব’-এর মাঠে সাহেব-সেনারা বল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে দেখে বছর আটের ছেলেটি গাড়ি থামাতে বলে। হেমলতা দেবীর বারণ সত্ত্বেও সে এগিয়ে যায় খেলা দেখতে। হঠাৎ বলটি একেবারে তার সামনেই। গোরা সৈন্যদের দেখেও ভয় না-পাওয়া ছেলেটি নিবিষ্ট হয়ে বলটা দেখছিল। সে সময়ে ব্রিটিশ সেনাদের বিশাল চেহারা দেখে তাদের ধারপাশও মারানোর সাহস পেত না সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্তরা। কিন্তু এ ছেলের কাণ্ড দেখে একটু অবাকই হল ব্রিটিশ সেনারা। ইংরেজদের এক জন বলে ওঠে, ‘কিক ইট!’ হাত থেকে নামিয়ে পায়ে মেরে বলটা ফেরত পাঠায় ছেলেটি। বাঙালির পায়ে সে-ই প্রথম ফুটবল শট। সেদিনের আট বছরের ছেলেটিই নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী।

নগেন্দ্রপ্রসাদের আদি নিবাস ছিল বর্তমান হুগলি জেলার রাধানগরে। ১৮৬৯ সালের ২৭ আগস্ট তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তার পিতা সূর্যকুমার সর্বাধিকারী ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিনে প্রথম ভারতীয় ডিন ছিলেন। মাতা হেমলতা দেবী। শোভাবাজারের রাজা আনন্দকৃষ্ণ দেবের মেয়ে কৃষ্ণকমলিনীর সঙ্গে নগেন্দ্রপ্রসাদের বিবাহ হয়েছিল। নগেন্দ্রপ্রসাদের ভাই বিনয়েন্দ্র প্রথম ভারতীয় টেনিস চ্যাম্পিয়ন। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ওয়েল্‌সের মের্সনিক লজের সর্বোচ্চ সম্মানপ্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় ডাঃ সত্যপ্রসাদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নন-অফিসিয়াল উপাচার্য দেবপ্রসাদ এবং কর্নেল সুরেশপ্রসাদ তার দাদা। তার ভাইপো বেরী সর্বাধিকারী ছিলেন বিখ্যাত বাঙালী ক্রীড়াবিদ, সাংবাদিক ও ক্রীড়া সংগঠক।

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন নগেন্দ্রপ্রসাদ ময়দানে অনেকরকম খেলার নেতৃত্ব দিতেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলার অদ্বিতীয় সেন্টার ফরওয়ার্ড হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিলেন।


ইংরেজ শাসনে বাঙালিকে বারবারই ভীতু, দুর্বল, অলস তকমা দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে নগেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন এক বিদ্রোহ। কৈশোর পার করার আগেই বেশ ক’টি ক্লাব গড়ে তোলেন। ‘বয়েজ ক্লাব’ ভারতের প্রথম ফুটবল সংগঠন। তাঁর হাত ধরেই গড়ের মাঠে প্রথম বাঙালি ক্লাবের তাঁবু পড়ে— ওয়েলিংটন ক্লাব।

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত শোভাবাজার ক্লাবের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি হাওড়াতে বন্ধু বামাচরণ কুণ্ডুর সাথে ভারতের প্রথম ফুটবল প্রতিযোগিতা ‘ট্রেডস কাপ’ আয়োজন করেন। তার চেষ্টায় বিভিন্ন শ্রমজীবী শ্রেণীর যুবকেরা অভিজাত ঘরের ছেলেদের সঙ্গে মিলেমিশে শরীরচর্চা করার সুযোগ পান। এই নিয়ে ওয়েলিংটন ক্লাবে আপত্তি ওঠায় তিনি ক্লাব ভেঙে দেন। তিনি এ বিষয়ে বলেন-

“আমি বুকের রক্ত দিয়ে ক্লাব তৈরি করেছি, বংশপরিচয় নিয়ে খেলোয়াড় তৈরি করিনি৷ জাতপাত নিয়ে খেলার আসর আমি সাজাব না, তৈরি করব খেলোয়াড় জাত।

১৮৯২ সালে শোভাবাজার ক্লাব ইউরোপীয় সমস্ত ক্লাবকে পরাজিত করে ফ্রেন্ডস কাপ জয় করে। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৯৩ সালে আইএফএ শিল্ডে শোভাবাজার ক্লাব একমাত্র ভারতীয় দল হিসেবে অংশগ্রহণ করে। যার মধ‍্যমণি ছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। খেলাজীবনে ৭০০-র বেশি ম‍্যাচ খেলেন। কেবল ফুটবল নয়, পারদর্শী ছিলেন ক্রিকেটেও। তিনি প্রথম ভারতীয় বোলার যিনি ইংরেজদের সঙ্গে খেলায় ওভারহেডিং বোলিং করতে পারতেন। আবার বাঙালি যুবকদের নিয়ে রাগবি দল তিনিই প্রথম তৈরি করেছিলেন।

নগেন্দ্রপ্রসাদ ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি কবি, সাহিত্যরসিক, নাট্যকার এবং নাট্যসমালোচক ছিলেন। তিনি শেক্সপিয়ারের টেম্পেস্ট এবং মার্চেন্ট অফ ভেনিস অনুবাদ করেছিলেন। হিন্দুধর্মশাস্ত্র এবং তন্ত্রশাস্ত্রে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি কীর্তন গানেও দক্ষ ছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল নগেন্দ্রপ্রসাদের। কথিত আছে ১৮৮০-এর দশকে স্বামীজি নিয়মিত নগেন্দ্রপ্রসাদের দলগুলির সঙ্গে ব্রিটিশ দলের লড়াই দেখতে আসতেন কলকাতা ময়দানে। আর খুব সম্ভবত এই প্রেক্ষিতেই স্বামীজি মন্তব্য করেন – “গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে পৌছানো সম্ভব।” 
১৮৯৭ সালে শোভাবাজার রাজবাটিতে এক অনুষ্ঠানে স্বামীজি নগেন্দ্রপ্রসাদকে দেখিয়ে বলেন- “ইংরেজদের কাছে সম্মান আদায় করিবার পদ্ধতি এই মানুষটি জানেন। ওর মতো মানুষ, ঐ রকম মরদ চাই আমাদের দেশে…”

নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর জীবন অবলম্বনে বাংলা চলচ্চিত্র গোলন্দাজ নির্মাণ করেছেন পরিচালক ধ্রুব ব্যানার্জী। যা মুক্তি পেয়েছে ১০ অক্টোবর ২০২১ ইংরেজি। এই ছবিতে নগেন্দ্রপ্রসাদের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দেব। ১৯৪০ সালে ১৭ জানুয়ারি প্রয়াত হন নগেন্দ্রপ্রসাদ।

নিজের সমগ্র জীবনটাকেই একটা সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। শুধু তো খেলাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া নয়, তাঁর লড়াই ছিল সমাজের সংকীর্ণতা, ঔপনিবেশিকতার অন্ধকার ডিঙিয়ে এক নতুন আলোর পথে উঠে আসার লড়াই। ১৯৪৫ সালে আই এফ এ নগেন্দ্রপ্রসাদকে সম্মান জানাতে আই এফ এ শিল্ডের বিজয়ী-কে ‘নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্মারক শিল্ড’ দেওয়া হয়।

১৯৭৭ সালে নগেন্দ্রপ্রসাদের স্মরণে ভারতীয় ফুটবলের শতবর্ষ পালন করা হয়। ওইটুকুই। তার বেশি স্মরণ, সম্মান— পাননি তিনি।

নগেন্দ্রপ্রসাদের সমস্ত জীবনটা খোদাই করা থাকল খেলার ময়দানে । বাঙালির ফুটবল জন্মের প্রায় দেড়শো বছরের ইতিহাসে মোহনবাগানের শিল্ড জয়, এশিয়াডে সোনা জয়, ইস্টবেঙ্গলের আশিয়ান জয়ের মতো মাইলস্টোনে যতবারই ফুটবল পায়ে নিয়ে বিশ্বে তিনরঙা পতাকাটা উড়েছে, ততবারই হয়তো জিতে গেছেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী, বাঙালির শ্রেষ্ঠ খেলার অদ্বিতীয় প্রাণপুরুষ। এই কিংবদন্তি নগেন্দ্রপ্রসাদ ভারতীয় ফুটবলের জনক ও ক্লাব ফুটবলেরও পথিকৃৎ। জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছে এখন সংবাদ পরিবার।

Related News

Also Read