Select Language

[gtranslate]
২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ শনিবার ( ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৫ )

।। সুমি ।।

উমা ভট্টাচার্য :- কোর্ট থেকে বেরিয়ে সুজাতা দেবী চুপ করে রইলেন।
সুমি কারণটা খুব বুঝতে পারল, কিন্তু মায়ের মনের অবস্থা বুঝে কিছু আর জিজ্ঞেস করলো না ।
শুধু বলল,”মা চলো একটা ভালো রেস্টুরেন্ট দেখে আমরা কিছু খেয়ে নেই, তারপর একটা উবের বুক করি।
সুজাতা দেবী বললেন,” তুই খেয়ে নে মা,আমার ইচ্ছে করছে না।
ইচ্ছে করছে না মানে, আমি কি বুঝি না তোমার খিদে পেয়েছে?

হ্যাঁ তা যদি বুঝতিস, তাহলে আমার খেতে ইচ্ছে না করার কারণ টাও বুঝতিস।
সুমি আস্তে করে বলল, হ্যাঁ মা আমি সেটাও বুঝেছি। আমি জানি তুমি এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছনা কিন্তু এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা মা। তুমি তো সব জানো, বোঝো।

তবে আমি আর এখন অন্ দা ওয়ে এসব আলোচনায় যেতে চাইছি না, খুব টায়ার্ড আমি আর খুব খিদেও পেয়েছে। কিছু খাই চলো।
তোমার যা বলার বাড়ি গিয়ে বোল।


একটা ভালো রেস্টুরেন্ট দেখে ওরা খেতে ঢুকলো
খেতে বসেও সুজাতা দেবীর খাওয়ায় কোন মন নেই,, সুমিও মাকে ওরকম দেখে তেমন কিছু খেলো না। রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে বাইরে এল, উবের বুক করার জন্য।
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ই ওরা বাড়ি চলে এল।

সুজাতা দেবী কোন কথা না বলে, নিজের ঘরে চলে গেলেন। সুমি ফ্রেশ হয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসল, আস্তে আস্তে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
একি, তুমি কাঁদছো মা? তোমার মেয়ে তোমার কাছে আছে, সে বেঁচে আছে। কেউ তাকে মারতে পারেনি।
আচ্ছা মা , আজ যদি আমার ডেড বডি টা তোমার কাছে আসতো, তাহলে কি তুমি আজকে বেশি কষ্ট পেতে না এর থেকে?

সুজাতা দেবী সুমির মুখে হাত দিয়ে বললেন, চুপ কর তুই,চুপ কর। কোন মা চায় তার মেয়ের সংসার এমন ভেঙ্গে যাক, তুই বুঝবি না এ যন্ত্রণা,
তোর বাবা আজ বেঁচে নেই, আমার শরীর ভালো নেই আমার কিছু একটা হয়ে গেলে, তুই কোথায় থাকবি, তো কে দেখবে বল? তোর কাকা কাকিমা কে তো জানিস। ওরা তোর এই ডিভোর্স এর ব্যাপারটা নিয়ে কত খারাপ খারাপ কথা বলেছে।

ও এই কথা? তোমার কিচ্ছু হবে না মা, তুমি খুব শীঘ্রই ভালো হয়ে উঠবে। আর আমাকে দেখার কথা বলছ, আমাকে তোমার দেখতে হবেনা, এখন থেকে আমি ই তোমাকে দেখব বুঝলে? বলে মায়ের গালে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে নিল সুমি।

বিয়ের পর থেকে তো, তোমাদের শরীর খারাপ শুনেও আসতে পারিনি, ওরা আমাকে আসতে দেয়নি। বাবার শেষ সময়টাতে আমাকে আসতে দিলোনা না না অজুহাতে, আমার তখন অত সাহস ছিল না ওদের মুখের উপর কিছু বলি, খুব কেঁদেছিলাম সেদিন।
আচ্ছা যার হাতে নিশ্চিন্ত হয়ে আমাকে তুলে দিয়ে ছিলে, সে বা তার পরিবার কি আমাকে দেখেছিল? আমার তো নিজেকেই নিজের দেখতে হয়েছে মা।


আচ্ছা মা, তুমি শোকেসে আমার ওই প্রাইজ গুলো দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ো আর হ্যাঁ আজ কিন্তু ইন্টার্নেশনাল ওমেন্স ডে, তোমার মেয়ে কিন্তু এখন সেই শান্ত ভীতু মেয়ে নেই, সে এখন সাহসী, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে।
আর স্বাবলম্বীও। তুমি অত অত চিন্তা কোরোনা ।
নাও একটু সরে শোও, আমি শোব। কতদিন তোমার পাশে শুইনা একটু নিশ্চিন্তে।
তুই বুঝতে পারছিস না সুমি। তোর কাকা কাকিমা এলে, তোকে-আমাকে ছেড়ে কথা বলবে, ভেবেছিস?
দেখলি তো,বাড়ির লোক হিসেবে একটা দিন ও গেল কোর্টে? এমনকি আজকের দিনটা তেও ওরা কেউ ছুটি নিল না।

ওদের নিয়ে ভেবোনা, আমি যা বলার বলবো ওদের।
ওদের তো আমাকে খাওয়াতেও হবেনা, আমার দায়িত্ব ও নিতে হবে না।
শুধু এই বাড়িটায় থাকবো, যে বাড়িটায় আমার পুতুল খেলার একটা ঘর ছিল, আমার ছোট্ট বেলার বাড়ি, আমার দাদান- ঠাম্মার বাড়ি, আমাদের বাড়ি।

কিছুক্ষণ পরেই সুমির কাকা কাকিমা চলে এলো, সুমিকে দেখে তারা যে খুব বিরক্ত বোধ করল, সেটা সুমি তাদের হাবেভাবে ই বুঝতে পারল।
সুমি দরজা বন্ধ করে আবার মায়ের কাছে এসে বসলো।
রাতে খেতে বসে সুমির কাকা চন্দন খুব বিদ্রুপ করেই সুমি কে বলল, তাহলে এবার তোর শান্তি হল বল? স্বাধীন দেশের স্বাধীন নারী , দারুন দারুন।
সুমি কোন উত্তর না করে চুপ করে থাকল।

সুমির কাকিমাও সুমির কাকার সাথে তাল মিলিয়ে বলা শুরু করলো,”শান্তি ,বলে শান্তি, ।দেখলেনা তোমার কথার কোন উত্তর করলো না, এত সাহস ওর।

চন্দন,এর জন্য দায়ী কিন্তু তোমার বৌদি , কোনটা ভালো কোনটা মন্দ উনি কি একটু বোঝাতে পারতেন না মেয়েকে।

সুমি এবারও বিশেষ কিছু না বলে শুধু আস্তে করে বলল, কাকিমা প্লিজ মাকে কিছু বলবেনা, তোমাদের যা বলার আমাকে বল।


চন্দন খুব উত্তেজিত হয়ে বলল, নিজের সম্মান তো হারালিই আর আমাদের ফ্যামিলির সম্মানের কথা ও একবার ভাবলিনা, পাড়ায় মুখ দেখাবো কি করে এখন? সবাই নানা কথা জিজ্ঞেস করবে অপমান করবে।


এবার সুমি আর চুপ থাকতে না পেরে বলল,পাড়ায় সম্মানের কথা বলছো কাকা, ঠাম্মার সাথে যখন দুর্ব্যবহার করতে চিৎকার চেঁচামেচি করতে তখন তোমাদের সম্মানের কথা মাথায় আসেনি? কিভাবে আমাদের ঠকিয়ে পুরো বাড়িটা নিজের নামে করতে গিয়েছিলে, সে তো সবাই জানে ।তখন লজ্জা লাগেনি তোমাদের?
পাড়ার লোক,কে কি ভাবল তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না, আমি তাদেরটা খাবও না পড়বোও না।
আমার সম্মান আমার কাছে, সমাজের চোখ দিয়ে নিজের সম্মান মাপতে আমি রাজি নই। আমি নিজেকে নিজে সম্মান দিলাম, এটাই আমার কাছে বড়। সমাজের লোকের কথা ভেবে নিজের লাইফ নষ্ট করতে পারব না।
চন্দন রেগে গিয়ে বলল,তা পারবি কেন, উচ্চশিক্ষিতা হয়েছিস না?


একটু মানিয়ে চললে তো ডিভোর্সটা অন্তত হত না।
কি বললে কাকা, উচ্চশিক্ষিতা?
আমার শিক্ষার বড়াই কোনদিনই ছিল না কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওই শিক্ষাটুকু ছিল বলে আমি আজ স্বাবলম্বী আর অপমান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে সম্মান দিতে পেরেছি।
আর মানিয়ে চলা? যেগুলি মানানোর , সেগুলি তো আমি অনেক মানিয়েই চলে আসছিলাম কিন্তু অন্যায় কে মানতে পারছিলাম না আর অন্যায় কে মানানো মানে তো অন্যায় কে সাপোর্ট করা, নিজেকে দুর্বল ভেবে ভয় করা।

একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি কাকা, পরিবারের হয়েও কোনদিন তো পাশে দাড়াওনি আমার , কিছু বলিনি তোমাদের কিন্তু আজ বলছি প্লিজ আমার ব্যাপারটা আমাকেই ভাবতে দাও।

কেন মানাতে বলে কি কিছু ভুল বলেছি? তোর বন্ধু রুপা তো সবকিছু মানিয়ে দিব্যি আছে, পরিমল তো ওর সাথে কম খারাপ ব্যবহার করেনি। অথচ তোর কাকিমার ফেসবুকে ওদের ছবি দেখে কত ভাল লাগে।
আর তুই? ছি ছি।

তাই? কাকা আমার হাসি পাচ্ছে।।
আচ্ছা কাকা, তুমি কি জানো, পরিমলদা এখনো রুপাকে মারধর করে , অন্য মেয়ে- বউদের দেখলে টিজ করে, গান করে।

হ্যাঁ রুপা ও জানে, ও কিছু বলে না পাছে ওর সাজান বাসা টা ভেঙে পড়ে।
রুপা বেরিয়ে আসতে পারে না, ও সমাজের চোখ দিয়ে নিজের ভালো থাকাটা, সম্মানটা দেখে। সবাই জানবে ও ভালো আছে কিন্তু ও নিজে জানে ও একদমই ভালো নেই, এটা কি জীবন, যে নিজের জন্য বাঁচে না?

আর শুধু রুপা কেন? মা যেদিন বিশ্বাস জেঠিমাকে আমার দুঃখের কথা বলছিল, সেদিন বিশ্বাস জেঠিমা সমব্যথী হওয়ার চেয়ে তার লম্পট জামাইয়ের কিনা প্রশংসা করল মায়ের কাছে, শুধুমাত্র নিজেকে মিথ্যে বড় সাজানোর জন্য।
এটাই সমাজ আর এই সমাজকে ইগনোর করে আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি সাহস করে, মিথ্যে সুখী দাম্পত্যের নাটক করতে হলো না।

আজ নারী দিবসে আমি জোর গলায় বলতে পারছি,আমি নিজেকে সম্মান দিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচতে পারব। সে সমাজের মানুষ যে যা খুশি ভাবুক আমাকে নিয়ে। জীবনটা আমার কাকা।
গুড নাইট কাকা, শুতে যাচ্ছি।
আমাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না।

সৌজন্যে প্রতিলিপি

Related News

Also Read