Select Language

[gtranslate]
২৭শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বুধবার ( ১২ই মার্চ, ২০২৫ )

।। মা ।।

কৃষ্ণা মিত্র :- নাহ, এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না! সেই সন্ধ্যে থেকে চা জলখাবার বানিয়ে বসে আছি। কিন্তু তার পাত্তাই নেই। আচ্ছা, ও তো জানে যে রোজ ও অফিস থেকে ফিরলে তারপর দুজনে একসাথে চা জলখাবার খাই। তা সত্বেও এখনো বাড়ি ফেরার নাম নেই। প্রায় আটটা বাজে! মনে মনে বেশ রাগ হয় অতসীদেবীর । কিছুক্ষণ পর আবার দুশ্চিন্তাও হয়। আচ্ছা, ওর কোনো বিপদ হল না তো! না না, এসব কি উল্টো পালটা ভাবছি! নাহ, একবার ফোন করেই দেখি।
বিছানা থেকে ফোনটা নিয়ে অতসীদেবী বীথির ফোনে ডায়াল করলেন। কিন্তু ফোন সুইচ অফ বলছে। তাহলে কোথায় আছে বীথি!
অতসীদেবী বারান্দায় এসে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। এমনসময় দরজায় কলিংবেলের শব্দ হল। অতসীদেবী দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে সামনে বীথিকে দেখে তাঁর যেন ধড়ে প্রাণ এলো।

ঘরে ঢুকেই খাবার টেবিলে চা জলখাবার সাজানো দেখে বীথি মুখটা কাঁচুমাচু করে অতসীদেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে — সরি মামণি, আমার আজ ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তুমি নিশ্চয়ই এখনো জলখাবার খাওনি! এসো, আগে খেয়ে নাও।
অতসীদেবীর সব রাগ , দুশ্চিন্তা নিমেষে মিলিয়ে যায়। তবু অভিমান করে বলেন —- থাক, আমার কথা আর ভাবতে হবে না। এতই যদি আমার জন্য চিন্তা তাহলে ফিরতে এত দেরি করলি কেন! আর ফোনটাই বা সুইচ অফ করা ছিল কেন!

প্লিজ মামণি, রাগ কোরো না। আসলে ফোনের চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছিল। পরে তোমাকে সব বলব। এখন তুমি খেয়ে নাও।
— তুই খাবি না?
— না গো, আমি খেয়ে এসেছি। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

********************

আজ বীথিকে ভীষণ অন্যমনস্ক লাগে অতসীদেবীর। অন্যদিন অফিস থেকে ফিরে কত গল্প করে, একসাথে বসে টিভি দ্যাখে। কিন্তু আজ ফেরার পর থেকে নিজের ঘরেই বসে আছে।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পাট মিটলে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অতসীদেবী দেখলেন বীথি বারান্দায় একলা অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অতসীদেবী গিয়ে বীথির কাঁধে আলতো করে হাত রাখতেই বীথি চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকায়। অতসীদেবী স্নেহভরা কণ্ঠে বলেন —- তোর কি হয়েছে রে মা! তোকে এমন চিন্তিত হতে আগে তো কখনো দেখিনি! আমি তো তোর মা, আমাকে বল। দেখবি মন হালকা লাগবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে বীথি। তারপর বলে — মা, বিতানের কথা তো তোমাকে আগেই বলেছি।
—- হ্যাঁ, তোর অফিস কলিগ তো!
—- হ্যাঁ, ও আমাকে অফিসের প্রথম দিন থেকে অনেক ব্যাপারে হেল্প করেছে। এই কয়েক বছরে আমরা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছি।
কয়েকদিন ধরেই ও আমাকে কিছু বলতে চাইছিল। আজ অফিস ছুটির পর একটা কফিশপে যাবার অনুরোধ করলে আমি আর এড়াতে পারলাম না।

কৌতুহলমাখা দৃষ্টিতে অতসীদেবী চেয়ে থাকেন বীথির মুখের দিকে।
বীথি মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে নিয়ে বলতে থাকে —- মা, বিতান আমাকে বিয়ে করতে চায়।
—- তুই কি বললি?
—- আমি একটু সময় চেয়েছি।
—- বোকা মেয়ে, সময় কেন, রাজি হয়ে যা। আমার জন্য ভাবিস না। আমার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, বাকি ক’টা দিন ঠিক চলে যাবে। তোর তো মা পড়ে রয়েছে পুরো জীবনটাই!
—- বীথি কিছু বলে না। কেবল সজল চোখে তাকিয়ে থাকে তারাজ্বলা আকাশের দিকে।

**************

রাতে ঘুম আসেনা অতসীদেবীর। হাজারো চিন্তা ভীড় করে আসে। মনে পড়ে যায় পাঁচ বছর আগের কথা। যেদিন তাঁর একমাত্র সন্তান রোহিতের মৃত্যু সংবাদ আসে। ট্রেন এক্সিডেন্টে রোহিত প্রাণ হারায়। সেদিন বীথির মুখের দিকে তাকিয়ে সন্তান হারানোর কষ্ট ভুলেছিলেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে স্বামী হারিয়ে বীথিও যেন বোবা হয়ে গিয়েছিল। রোহিতের মৃত্যুটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। রোহিতের সাথে বিয়ের একবছরের মধ্যেই এই শোক সামলে ওঠা ওর পক্ষে খুবই কঠিন ছিল। তাই ওকে সামলাতে গিয়ে অতসীদেবী নিজের শোক ভুলেছিলেন। বৌমা যে কখন নিজের মেয়ে হয়ে উঠেছিল তা বুঝতেও পারেন নি।

*****************

রোহিত মারা যাবার পর বীথিকে ওর দাদা নিজের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু বীথি রাজি হয়নি। কারণ রোহিত ছাড়া অতসীদেবীর আর কেউ ছিল না। রোহিতের মৃত্যুর পর অতসীদেবী বীথিকে নিয়েই বেঁচে আছেন। দশবছর আগে বীথির মা মারা গিয়েছিলেন। অতসীদেবীর মধ্যেই বীথি নিজের মাকে খুঁজে পেয়েছিল। তাই আর মাকে একলা ফেলে রেখে অন্যত্র চলে যেতে পারেনি বীথি। কিন্তু রোহিতের কথা ভেবে সবসময় মনমরা হয়ে থাকত।

অতসীদেবীর স্নেহ ভালোবাসা আর সময়ের সাথে সাথে বীথি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। অতসীদেবীই বীথিকে বলেন কোনো চাকরির চেষ্টা করতে, যাতে ওর সময়ও কাটে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। কয়েকমাস চেষ্টা করার পর একটা চাকরি জোগাড় করে বীথি। অতসীদেবী খুব খুশি হন। ছুটির দিনে প্রায়ই বীথি অতসীদেবীকে নিয়ে বাইরে যায়। টুকটাক কেনাকাটা করে, কখনো মুভি দ্যাখে, তারপর বাইরে খেয়ে বাড়ি ফেরে। এভাবেই দিনগুলো দিব্যি কেটে যায় দুজনের।

******************

অফিসের সকলের সাথেই বীথির ভালো সম্পর্ক, তবে বিতানকে বীথির বেশ লাগে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়।বিতান বীথির জীবনের সবকথাই জানে। সব জেনেও আজ যখন বিতান বীথিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তখন থেকে বীথির মন এক অদ্ভুত দোলাচলে দোদুল্যমান হয়ে আছে। যদিও বিতান বলেছে যে ওর বাড়িতে এ ব্যাপারে সবাই সবকিছু জানে, আর তাদের কোনো আপত্তি নেই এ বিয়েতে। কিন্তু বীথি ভাবে রোহিতের কথা, অতসীদেবীর কথা….. বিশেষ করে বীথি এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে অতসীদেবী একেবারে একলা হয়ে যাবেন। আবার বিতানকে ফিরিয়ে দেবার সাধ্যও যে নেই ওর। কি করবে এখন ও….!

*********************

বীথির মুখে এর আগে বিতানের কথা অনেক শুনেছেন অতসীদেবী, ছেলেটা সবদিক থেকেই ভালো। ভালোই হবে ওদের জুড়ি। নিজেকে আর ওদের মধ্যে আটকে রাখা কোনোমতেই ঠিক নয়, মনস্থির করেন অতসীদেবী।


পরদিন সকালে বীথি অফিস যাওয়ার আগে ব্রেকফাস্ট করতে বসলে অতসীদেবী বললেন —- বীথি, তুই বিতানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যা।
—- কিন্তু মামণি, আমি চলে গেলে তুমি তো একেবারে একলা হয়ে যাবে!
—- দূর বোকা মেয়ে, তুই তো এই শহরেই থাকবি। সময় পেলে এসে আমার সাথে দ্যাখা করে যাবি তাছাড়া ফোন তো আছেই। ইচ্ছে হলেই ফোনে তোর সাথে কথা বলব। তাই বলে কি মা মেয়ের বিয়ে দেবে না! আমি সর্বান্তকরণে তোদের দুজনকে আশীর্বাদ করি, তোরা খুব সুখী হবি।

টেবিল ছেড়ে উঠে এসে বীথি অতসীদেবীকে জড়িয়ে ধরে। মা মেয়ে দুজনের চোখেই অশ্রুনদী বাঁধ ভাঙে।


সৌজন্যে – প্রতিলিপি

Related News