Select Language

[gtranslate]
১২ই পৌষ, ১৪৩১ শুক্রবার ( ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ )

সোহাগী

তুষার সেনগুপ্ত:-সোহাগীর আজ সকাল থেকেই মন ভালো নেই। তিন বাড়ির ঠিকে কাজ, বাসন মাজা আর ঘর ঝাড়-পোঁছ। নায়েক গিন্নি বাপের বাড়ি গেছে। কেন কে জানে গিন্নি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি গেলে দাদা একা থাকলেই সোহাগীর সবেতন ছুটি। এইতো আজই, মহালয়ার দিন গেল। ফিরতে ফিরতে সেই লক্ষীপুজো। যাওয়ার আগে অবশ্য শাড়ি-সায়া-ব্লাউজ ঠিক মনে করে দিয়ে গেছে, সঙ্গে একশো টাকা পুজোর বকশিসও। নায়েক বাড়ি ছুটি, বাকি দু’বাড়িতেও ডুব মেরে দিলো সোহাগী। তিন বছর হয়ে গেলো বিয়ে হয়েছে। সেই সুদুর মেদনিপুরের কোলাঘাট থেকে একেবারে উড়িষ্যার পারাদ্বীপের এই মেছুয়া বস্তিতে। ছেলেপুলে হয়নি বলে পাড়া পড়শী গুজগুজ ফুসফুস করে। কানে এলেও গায়ে মাখেনা। আজ একটু তরিবৎ করেই রাঁধছে সোহাগী। বাঙালি হলেও উড়িয়া ঘরের বৌ তো! বিয়ের পরেপরেই তাই ডালমা রাঁধাটা শিখে নিয়েছে। অন্যদিন হলে চার-পাঁচ হাতা ডালমা দিয়েই দু’থালা গরম ভাত জগাইয়ের পেটে সেঁধিয়ে যায় মুহুর্ত্তের মধ্যে। আজ আবার তার সাথে কষাকষা মুরগীর মাংস। রান্না শেষ। সার কারখানার বেলা দুটোর সাইরেন বেজে গেলো। বেআক্কেলে লোকটার এখনও পাত্তা নেই। সেই সাত সকালে একথালা পখাল আলুচোখা দিয়ে সাঁটিয়ে কোথায় যে চড়তে গেলো, নিশ্চয় তাসের আসরে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে জানলা দিয়ে আকাশটা দেখল। কেমন যেন মেঘলা মেঘলা ভাব। অজানা আতঙ্কে কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে মনেমনে জগন্নাথের কাছে মানত করে নিলো। এ’যাত্রায় জগাই ফিরলেই একেবার পুরী গিয়ে মহাপ্রভুর চরণে পুরো একশো এক টাকার পুজো চড়িয়ে আসবে।

*****

জগাইয়ের ভালোবাসার মিষ্টি অত্যাচারে সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি সোহাগী। জগাইয়ের মৃদু ধাক্কায় চোখ খুলেই বুঝল, স্বামীসোহাগের ক্লান্তিতে কাকভোরে জগাইয়ের উদোম চওড়া বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখ খুলে জগাইয়ের সুঠাম শরীরে নিজের শরীরটা একেবারে মিশিয়ে দিয়ে আবেশ মাখানো আদুরে গলায়, অদ্ভুত একটা স্বভাবসুলভ উড়িয়া মেশানো বাংলায় বলল,

– “হ্যাঁগো! মেঘটা ভালো ঠেকতিসে না, তমে সত্যই যিবা পড়িব ?”

কোনও উত্তর না দিয়ে, সোহাগীর ঠোঁটে হালকা চুমু খেয়ে জগাই উঠে পড়লো। এখুনি তৈরি হয়ে বেরতে হবে। বাকী সবাই বোধহয় এতক্ষণে এসে গেছে। সকাল সকাল ট্রলার না ছাড়লে জাহাজের যাতায়াত শুরু হয়ে যাবে, পোর্টের সিগনাল স্টেশন আর যাওয়ার অনুমতি দেবেনা।

সোহাগীর বানানো মিষ্টি চা, সাথে গত রাতের দুটো বাসী রুটি। কোনও মতে রুটির শেষ টুকরোটা মুখে ঢুকিয়েই বেড়িয়ে পড়লো জগাই আর প্রতিবারের মতই পিছুপিছু সোহাগী। প্রায় দৌড়তে দৌড়তে জেটিতে পৌঁছে দেখল সাগরপারী দিতে ওদের ট্রলার তৈরি। জগাইয়ের জন্যেই অপেক্ষা করছে। জেটির সাথে বাঁধা ট্রলারের দড়িটা খুলে দিয়েই লাফ দিয়ে চড়ে গেলো ট্রলারে। ভুটভুট শব্দ করতে করতে ট্রলারটা ব্রেকওয়াটার পেরিয়ে ক্রমশই দূরে আরও দূরে……..

*****

ক্রমশ আবছা হতে থাকা ট্রলারটা অসীম দরিয়ায় মিলিয়ে যেতেই সজল চোখে ঘাড় ঘোরাতেই সোহাগীর নজরে পড়লো সুভদ্রাকে। এইতো গতবছর ঠিক দুগ্গাপুজোর আগে আগেই সুভদ্রার কপাল পুড়ল। মহালয়ার দিন সাতসকালে ট্রলার ভাসল। আরও আটজনের সাথে বলরামও গেল সমুদ্রে মাছ ধরতে। কে জানতো মহা অষ্টমীর সন্ধ্যেয় তছনছ করে দেবে সবকিছু। রাক্ষুসে তুফান ফাইলিনে হারিয়ে গেলো ট্রলারটা। সুভদ্রা কিন্তু এখনও বলরামের ফেরার অপেক্ষায় রোজ কাকভোরে দূর দরিয়ার বুক চিরে উঠতে থাকা লাল সূর্যটার মঝে খুঁজে বেড়ায় সেই লাল কালো ডোরাকাটা ট্রলারটা….

এই প্রথমবার সোহাগী সুভদ্রার মধ্যে নিজের ছায়া খুঁজে পেল। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আলতো করে হাত রাখল সুভদ্রার কাঁধে। ততোক্ষণে লাল সূর্যটা গনগনে হলুদ। মালবাহী জাহাজগুলোর আনাগোনা শুরু। ফিসফিসিয়ে সুভদ্রার কানেকানে বললো-

– “কাল ভোরে আসার আগে আমাকেও ডাকিস…”

বলেই হনহন করে পা চালাল নোয়াবাজারের পোর্ট কোয়ার্টারের দিকে। কাল ডুব দিয়েছে, আজ কাজে না গেলে গিন্নিরা আর আস্ত রাখবে না……

সৌজন্যে – প্রতিলিপি

Related News

Also Read