কৃষ্ণা দাসসেন :- দূর থেকে ভেসে আসছে, ‘ বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও –!’
শ্রীর ভেতরে যত দুঃখ যন্ত্রণা আবেগ, ভালোলাগা- সব এক হয়ে মিশ্র অনুভূতিতে ছেয়ে গেল মনটা। নিজের অজান্তেই সে ফিরে গেল অতীতে ।
কোন ছোট্টবেলায় মাকে হারিয়েছে। মাসি আর মেসোর কাছে মেয়ের মতই মানুষ। মাকে হারানোর দুঃখে বাবা সন্নাস গ্রহণ করল। অপরিচিত রইল বাবা তার কাছে।
স্কুল জীবনে শ্রী , মিঠি আর বিমল- তিন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ! খেলা , স্কুলে যাওয়া সবই চলতো একসাথে -এক পাড়ায় বাড়ি ছিল বলে । মিঠির বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ ছিল। কিন্তু দেখতে বেশ সুশ্রী হওয়ার জন্য ভালো ছেলে পাওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিকের পরই মিঠির বিয়ে হয়ে গেল।
রইল বিমল আর শ্রী। স্কুল থেকে পাশ করেই বিমল যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেল। বিমল একদিন বলল, ‘শ্রী, তোকে আমি ভালোবাসি । তুই আমার সাথে সারা জীবন থাকবি তো ?’ শুনে সদ্য তরুণী শ্রীর বুকে সে কি ঢিপঢিপ আওয়াজ ! মনে হচ্ছে নিজের কানের কাছেই যেন বাজছে দামামা। কিন্তু মুখে বলে ! ‘কিরে, তুই হঠাৎ কি সব বলছিস? শরীর ভালো আছে তো ?’ বলে ছদ্ম গাম্ভীর্যে বিমলের কপালে হাত রাখতে যায়। বিমল মাথা সরিয়ে নেয়, ‘ যা যা ! তোকে আর কোনদিন মনের কথা বলবো না ।’
শ্রী তাকালো তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে। ‘জানিস না ? বুঝিস না আমার মনের কথা ? ‘ দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল অপলকে।
দুজনেই উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করার পর বিমল ঢুকলো ডাক্তারি পড়তে মেডিকেলে, শ্রী অংকে অনার্স নিয়ে যাদবপুরে। দুজনেই পড়াশোনায় খুব ভালো । তবে পড়ার ব্যাপারে দুজনের পছন্দ ছিল আলাদা।
এরপর তাদের মনের জগৎটা পুরো পাল্টে গেল। দুজনের মনের গভীর বোঝাপড়া বাইরে থেকে কেউ বুঝতেই পারতো না কারণ বিমলের ব্রাহ্মণ পরিবার নমঃশূদ্র শ্রীকে বাড়ির বউ করবে না-এ ওরা দুজনেই জানতো। তাই লক্ষ্য ছিল চাকরি করে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো, তারপর বিয়ে।
দুজনের কলেজ শেষে অথবা ছুটির দিনে তারা পাড়ি দিত অনেক দূরে নতুন জায়গায়। কখনো সবুজ মাঠ, আবার কখনো কুলকুল করে বয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে গিয়ে বসতো। কখনো বা নদীর বুকে নৌকায় চড়ে ওরা ভাসতো। নৌকা খানিক টলে উঠলে তাকে বিমল আগলে নিতো। আবেগ তাড়িত হয়ে শ্রী বলতো , ‘এমনি করে সারা জীবন ধরে রাখবি তো ?’ বিমল তিন সত্যি করত।
‘রাখব ! রাখব !রাখব ! হল ?’ শ্রীর মুখে হাসি ফুটতো। দুজনেই হাসতো দুজনের দিকে তাকিয়ে । বড় উজ্জ্বল সে হাসি – কথা নেওয়ার, কথা রাখার শপথের হাসি ।
শ্রী এমএসসি পাস করলো। বিমল যথাসময়ে হাউস্টাফ মেডিকেল কলেজে ।
কিছুদিন গেলে বিমল বলল, ‘জানিস, বিদেশ একবার পাড়ি দিতেই হবে। বিদেশে কিছুদিন পড়াশোনা আর ডাক্তারি না করলে ডাক্তারিটা ঠিক শেখা সম্পূর্ণ হয়না।’
‘মন দিয়ে পড়াশোনা কর। ভালো রেজাল্ট কর । দেখবি তোর মনের ইচ্ছা পূরণ হবেই ।’শ্রী বিমলকে উৎসাহ দিত।
কিছুদিন ধরে শ্রী বুঝতে পারছে বিমল যেন কেমন অন্যমনস্ক। বেশ ক’দিন বাদে বাদে দেখা করে। দেখা হলেও সে উচ্ছ্বাস আর দেখা যায়না । শ্রী নিজেকেই ধমকানি দেয় । বিমল তার ছোট্টবেলার বন্ধু। তাকে সে সন্দেহ করছে ? ছি ছি! নিজেকে সে ধিক্কার দিলো । একদিন বিমল শ্রীর কাছে
হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ‘ আমি লন্ডন যাচ্ছি। এম এস করার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এক মাস বাকি । এর মধ্যে সব গোছগাছ করে নিতে হবে। অনেক কাজ আছে।’ শ্রী হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বিমলের ব্যস্ত সমস্ত মুখের দিকে। কথা বলার সুযোগ পেয়ে বলে, ‘ কই , তুই তো আগে এতবড় কথাটা আমায় বলিস নি ?’ ‘আরে সুযোগই হয়নি ! এমন তাড়াহুড়ো করে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল-!’ ‘কি করে ব্যবস্থা হল ?’ ‘ডক্টর মিত্র আমার ফাইনালের রেজাল্ট দেখে খুব খুশি । উনি আমাদের কার্ডিয়লজি ডিপার্টমেন্টের হেড। উনি বললেন, এমন ছেলেকে তো এখানে পড়ে মার খেতে দেওয়া যায়না ।
তাই উনি সব ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রচুর ক্ষমতা আছে ওঁর ।’ ‘ওঁর কে কে আছে?’ ‘কেবল মেয়ে রুক আছে । এমএসসি পড়ছে কেমিস্ট্রিতে।
সামনের বছর ফাইনাল ।’ ‘তারপর সেও কি লন্ডন যাবে ?’ ‘কে জানে ! বাবার এত সোর্স আছে যার সে কি করবে কে জানে !’ বলে কি মনে হতেই শ্রীর দিকে তাকালো । ‘এভাবে কথা বলছিস কেন শ্রী?’ শ্রী আনমনে বলে, ‘ তুই যাচ্ছিস এখন । স্যারের মেয়ে তো যেতেই পারে আগামী বছর।’ ‘তুই এমন ভাবে কথা বলিস না ! আমি তো নিজে তোকে বলতে এলাম। চলে যাব । মেজাজটাই খারাপ করে দিলি। আমি চললাম ।’ বলে রেগে বিমল চলে গেল। শ্রী নির্বাক !
বিমলের রাগ সে কখনো দেখেনি আগে। আজ এ কি দেখলো ? কিছুদিন ধরে বিমল যে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে তাও সে বুঝতে পারছিল । কি যে হচ্ছে বুঝতে পারা না পারার মাঝে দুলছে শ্রী।
কয়েক মাস হলো বিমল চলে গেছে। এর মধ্যে বিদেশে গিয়ে পৌঁছানোর খবর দিয়েছিল । তারপর সে বার কয়েক কথা বলেছিল কিন্তু কথার ভেতরে ছিল শুধু দায়সারা মনোভাব যা শ্রীকে ভয়ংকর এক শূন্যতায় ফেলে দিয়েছিল। তারপর গাঢ় নিস্তব্ধতা ! শ্রী ফোন করে করেও কোনো খবর পায়নি।
শ্রীর মানসিক ভারসাম্য টলে উঠেছিলো । ওর মাসি মেসো কেউ নেই। এখন সে একেবারেই একা, ইতিমধ্যে একটা কলেজে শ্রী চাকরি পেল। নিঃসঙ্গ শ্রী কলেজের ছাত্রী, সহকর্মীদের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখে । ছাত্রীদের পড়াশোনার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে কাজের মধ্যে সময় কাটাবার চেষ্টা করে। বিমল গেছে আজ দু ‘বছর হল । কিছুদিন আগে একবার জানিয়েছিল রুক পৌঁছেছে লন্ডনে। তারপর আর তার কোন খবর নেই। শ্রী অনেক কষ্টে হতাশার এক অন্ধকার গহবর থেকে নিজেকে টেনে তুলেছে। চায়না সে আবার কোন হতাশায় ডুবে যেতে – রুক বিমলের কোন খবর পেতে। তাই যা হওয়ার ছিল তা সে মেনে নিয়েছে। মেনে নিয়েছে রূককে বিমলের বিয়ে করার কথা।
নিজের কর্মক্ষেত্রকে সে বড় বেশি করে তাই আঁকড়ে ধরেছে।
হঠাৎ করে মিঠির ফোন পেয়ে শ্রীর মনটা আনন্দে ভরে গেল । দুই বন্ধুর ফোনে গল্প আর শেষ হয়না। মিঠি জানালো সে আছে ব্যাঙ্গালোরে । অনেক কষ্টে শ্রীর ফোন নং সে জোগাড় করেছে । দুই বন্ধু উভয়ের কাছে উজাড় করে দিল নিজেদের মন । মিঠি জানল শ্রীএর গভীরতম কষ্টের কথা। সেই ত্রয়ীর বিমল এত বদলে গেল ? মিঠির যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না !
যাইহোক শ্রী মিঠিকে পেয়ে নিজের কষ্টটা ভুলতে পেরেছিল। একবার মিঠি কলকাতায় শ্রীএর কাছে এলে দুই বন্ধুতে আবার ফিরে গিয়েছিল সেই ছোটবেলায়। শ্রীও মিঠির ডাকে তার সংসারে না গিয়ে পারেনি। তার দুই ছেলেমেয়ের নতুন মাসিমনির সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল। মিঠির বর তো মহাদেবের মত উদার মনের মানুষ। তাকে পেয়ে নিজের দাদাকে পাওয়ার স্বাদ মিটিয়েছিল শ্রী। শ্রী বেশ ক’টা দিন ওদের মধ্যে থেকে ওদের পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছিল ।
এভাবে ছোটবেলার বন্ধুত্ব পরিণত বয়সে আরো গাঢ় হয়ে উঠল।
ঐভাবে বেশ কিছুদিন আনন্দে কাটলেও একদিন মিঠির ছেলের কাছ থেকে খবর পেল স্ট্রোকে তার মা আর নেই। সে ছুটে গিয়েছিল ।
শ্রী আবার তার কাছের বন্ধুকে হারালো । শ্রী আর কত সামলাবে নিজেকে একা একা ! তাও চলতে তো হয়ই । মাটিতে পড়ে গেলে দু’হাত দিয়ে সেই মাটিতেই আঁকড়ে ধরে উঠতে হয়। শ্রীকেও তাই করতে হলো । আবার তার জীবন আবর্তিত হতে থাকলো শুধু বাড়ি আর কলেজ করে।
পঁয়ত্রিশ ছোঁয়া শ্রীএর জীবনে এখন বিমল এক অসম্মানের স্মৃতি, মিঠি এক কষ্টের স্মৃতি। একদিন হঠাৎই সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘পরিবেশ’ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখার মাধ্যমে লন্ডনে এক প্রবাসী অবাঙালি রাহুল দেবের সঙ্গে ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব হল শ্রীএর । বলা ভালো রাহুল দেব বন্ধুত্ব করলো। রাহুল লন্ডনে এক বিখ্যাত গবেষণাগারের অভিজ্ঞ গবেষক। রাহুলের সঙ্গে নানান বিষয়ে কথা বলে শ্রী মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার আস্বাদ পায় । কিছুদিন পরে জানতে পারে শিশু চিকিৎসক ডক্টর বিমলের সঙ্গে অল্প হলেও তার পরিচয় আছে। বিমলের স্ত্রী রূক তাকে ছেড়ে চলে গেছে। একাকী জীবন তার । আশ্চর্য এতে শ্রীর আনন্দ বা দুঃখ কিছুই হলোনা। বড় নির্লিপ্ত সে। গড়ে উঠলো চিরকুমার রাহুল – শ্রীএর এক সুন্দর বন্ধুত্ব ! সারাদিন কাজে ব্যস্ত থেকে ওরা সারাদিনের কষ্ট আনন্দ সবকিছু উভয় উভয়ের কাছে ঢেলে দেয় মুঠোফোনের মাধ্যমে। তবে তাদের মধ্যে আলাদা করে কোন চাওয়া পাওয়া নেই । তাই না পাওয়ার- হতাশার দুঃখও নেই ! ভিডিও কলের মাধ্যমে মাঝে মাঝে দেখা হলেও সামনাসামনি অদেখা বন্ধুর নির্ভেজাল বন্ধুত্ব শ্রীএর জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে। রাহুল তার জীবনে এক আলোকবর্তিকা । মাঝে মাঝে হতাশার অন্ধকারে শ্রী ডুবলেও আবার উঠে দাঁড়ায় এই নির্ভেজাল বন্ধুত্বের আলোয় আলোকিত হয়ে !