Select Language

[gtranslate]
১২ই পৌষ, ১৪৩১ শুক্রবার ( ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ )

।। স্বামীজীর সহিত কয়েক দিন ।।

হরিপদ মিত্র :- একদিন স্বামীজী বলিলেন, ‘তোমার সহিত জঙ্গলে তাঁবু খাটাইয়া আমার কিছুদিন থাকিবার ইচ্ছা। কিন্তু চিকাগোয় ধর্মসভা হইবে, যদি তাহাতে যাইবার সুবিধা হয় তো সেখানে যাইব।’ আমি চাঁদার লিষ্ট করিয়া টাকা-সংগ্রহের প্রস্তাব করায় তিনি কি ভাবিয়া স্বীকার করিলেন না। এই সময় স্বামীজীর ব্রতই ছিল, টাকাকড়ি স্পর্শ বা গ্রহণ করিবেন না। আমি অনেক অনুরোধ করিয়া তাঁহার মারহাট্টি জুতার পরিবর্তে একজোড়া জুতা ও একগাছি বেতের ছড়ি দিয়াছিলাম। ইতঃপূর্বে কোলাপুরের রাণী অনেক অনুরোধ করিয়াও স্বামীজীকে কিছুই গ্রহণ করাইতে না পারিয়া অবশেষে দুইখানি গেরুয়া বস্ত্র পাঠাইয়া দেন। স্বামীজীও গেরুয়া দুইখানি গ্রহণ করিয়া যে বস্ত্রগুলি পরিধান করিয়াছিলেন, সেগুলি সেইখানেই ত্যাগ করেন এবং বলেন, সন্ন্যাসীর বোঝা যত কম হয় ততই ভাল।


ইতঃপূর্বে আমি ভগবদ্‌গীতা অনেক বার পড়িতে চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু বুঝিতে না পারায় পরিশেষে উহাতে বুঝিবার বড় কিছু নাই মনে করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। স্বামীজী গীতা লইয়া আমাদিগকে একদিন বুঝাইতে লাগিলেন। তখন দেখিলাম, উহা কি অদ্ভুত গ্রন্থ! গীতার মর্ম গ্রহণ করিতে তাঁহার নিকটে যেমন শিখিয়াছিলাম, তেমনি আবার অন্যদিকে জুল ভার্ন (Jules Verna)-এর Scientific Novels এবং কার্লাইল (Carlyle)-এর Sartor Resartus তাঁহার নিকটেই পড়িতে শিখি।

তখন স্বাস্থ্যের জন্য ঔষধাদি অনেক ব্যবহার করিতাম। সে কথা জানিতে পারিয়া একদিন তিনি বলিলেন, ‘যখন দেখিবে কোন রোগ এত প্রবল হইয়াছে যে, শয্যাশায়ী করিয়াছে আর উঠিবার শক্তি নাই, তখনই ঔষধ খাইবে, নতুবা নহে। Nervous debility (স্নায়ুবিক দুর্বলতা) প্রভৃতি রোগের শতকরা ৯০টা কাল্পনিক। ঐ-সকল রোগের হাত হইতে ডাক্তারেরা যত লোককে বাঁচান, তার চাইতে বেশী লোককে মারেন। আর ওরূপ সর্বদা ‘রোগ রোগ’ করিয়াই বা কি হইবে? যত দিন বাঁচ আনন্দে কাটাও। তবে যে আনন্দে একবার সন্তাপ আসিয়াছে, তাহা আর করিও না। তোমার আমার মত একটা মরিলে পৃথিবীও আপনার কেন্দ্র হইতে দূরে যাইবে না, বা জগতের কোন বিষয়ের কিছু ব্যাঘাত হইবে না।’

এই সময়ে আবার অনেক কারণবশতঃ উপরিস্থ কর্মচারী সাহেবদের সহিত আমার বড় একটা বনিত না। তাঁহারা সামান্য কিছু বলিলে আমার মাথা গরম হইয়া উঠিত এবং এমন ভাল চাকরি পাইয়াও একদিনের জন্য সুখী হই নাই। তাঁহাকে এ-সমস্ত কথা বলায় তিনি বলিলেন, ‘কিসের জন্য চাকরি করিতেছ? বেতনের জন্য তো? বেতন তো মাসে মাসে ঠিক পাইতেছ, তবে কেন মনে কষ্ট পাও? আর ইচ্ছা হইলে যখন চাকরি ছাড়িয়া দিতে পার, কেহ বাঁধিয়া রাখে নাই, তখন বিষম বন্ধনে পড়িয়াছি ভাবিয়া দুঃখের সংসারে আরও দুঃখ বাড়াও কেন? আর এক কথা, বল দেখি—যাহার জন্য বেতন পাইতেছ, অফিসের সেই কাজগুলি করিয়া দেওয়া ছাড়া তোমার উপরওয়ালা সাহেবদের সন্তুষ্ট করিবার জন্য কখনও কিছু করিয়াছ কি? কখনও সেজন্য চেষ্টা কর নাই, অথচ তাহারা তোমার প্রতি সন্তুষ্ট নহে বলিয়া তাহাদের উপর বিরক্ত! ইহা কি বুদ্ধিমানের কাজ? জানিও, আমরা অন্যের উপর হৃদয়ের যে ভাব রাখি, তাহাই কাজে প্রকাশ পায়; আর প্রকাশ না করিলেও তাহাদের ভিতরে আমাদের উপর ঠিক সেই ভাবের উদয় হয়। আমাদের ভিতরকার ছবিই জগতে প্রকাশিত রহিয়াছে—আমরা দেখি। আপ্ ভালা তো জগৎ ভালা—এ কথা যে কতদূর সত্য কেহই জানে না। আজ হইতে মন্দটি দেখা একেবারে ছাড়িয়া দিতে চেষ্টা কর। দেখিবে, যে পরিমাণে তুমি উহা করিতে পারিবে, সেই পরিমাণে তাহাদের ভিতরের ভাব এবং কার্যও পরিবর্তিত হইয়াছে।’ বলা বাহুল্য, সেই দিন হইতে আমার ঔষধ খাইবার বাতিক দূর হইল এবং অপরের উপর দোষদৃষ্টি ত্যাগ করিতে চেষ্টা করায় ক্রমে জীবনের একটা নূতন পৃষ্ঠা খুলিয়া গেল…….

রামকৃষ্ণ পরিশিষ্টং
যুগধর্ম প্রবর্তকং।
মুনিন্দ্রং কর্মযোগীনং
দেবলোচনং ভাস্করম।।
পরিত্রায়ণায় ভারতস্য
দীনহীন সেবায় চ।
শিবরূপ অবতীর্ণং
বিবেকানন্দ প্রণমামি।।

Related News

Also Read