রথযাত্রা উৎসবের পঞ্চম দিনে অর্থাৎ শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে গুণ্ডিচা মন্দিরে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান ❝হেরা পঞ্চমী❞ অনুষ্ঠিত হয়। ❝হেরা❞ শব্দের অর্থ দর্শন করা বা দেখা করা। রথযাত্রা উপলক্ষ্যে বিষ্ণুরূপী জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা রথে করে যখন মাসীর বাড়ী গুণ্ডিচা মন্দিরে যান তখন জগন্নাথের পত্নী মহালক্ষ্মীকে তিনি মন্দিরেই রেখে যান, তাই মহালক্ষ্মী জগন্নাথের উপর ক্রুদ্ধ হন।
স্বামীকে কয়েকদিন না দেখে তিনি স্বামীর জন্য উদ্বিগ্ন হন যে তিনি কেমন আছেন, কি করছেন ইত্যাদি নানান চিন্তা করেন। তাই প্রিয় স্বামী জগন্নাথ প্রভুকে দেখার জন্য এবং তাঁকে মন্দিরে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি গুণ্ডিচা মন্দিরের দিকে যাত্রা করেন। সুবর্ণ মহালক্ষ্মী রূপে মাতা লক্ষ্মীকে সুন্দর বস্ত্র আর অলঙ্কারে সাজিয়ে সুদর্শন পালকিতে বসিয়ে এই পঞ্চমীর দিন মন্দিরের সেবকরা মাতাকে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে আসেন বাদ্যযন্ত্র আর শোভাযাত্রা সহকারে। গুণ্ডিচা মন্দিরের কাছে একজন ব্রাহ্মণ দেবী মহালক্ষ্মীকে আরতি করে স্বাগত জানান, চারদিকে উলুধ্বনি হয়। কিন্তু মহালক্ষ্মীকে ক্রুদ্ধ দেখে জগন্নাথের সেবকেরা গুণ্ডিচা মন্দিরের প্রধান দরজাটি বন্ধ করে দেন। মহালক্ষ্মীর সাথে তাঁর স্বামী প্রভু জগন্নাথের সেদিন প্রত্যক্ষ দর্শন হয় না, কিন্তু দেবী গুণ্ডিচা মন্দিরের দিকে তাকিয়ে জগন্নাথের উদ্দেশ্যে যেন বলেন, ❝অনেক হলো মাসীর বাড়িতে আদর যত্ন, এবার মন্দিরে ফিরে চলো।❞ এ যেনো স্বামী আর স্ত্রীর মান অভিমানের পালা। এই অনুষ্ঠান দেখতে এই সময়ে প্রচুর ভক্তগণ দলে দলে মন্দিরে আসেন। প্রভু জগন্নাথ দেবীকে ❝আজ্ঞা মালা❞ (সম্মতি জানিয়ে মাল্য দান) প্রেরণ করে মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেন, যা লক্ষ্মীদেবী গ্রহণ করেন। কিন্তু জগন্নাথ তখনও মূল মন্দিরে ফিরে যেতে রাজি হননা। তাতে দেবী লক্ষ্মী ক্ষুব্ধ হন। তিনি তাঁর এক সেবককে জগন্নাথের রথ নন্দী ঘোষের একটি অংশ ভেঙে দিতে আদেশ করেন৷ জগন্নাথের রথ ❝নন্দীঘোষ❞কে সামান্য খুঁতযুক্ত করার নিয়মটিকে ❝রথভঙ্গ❞ বলা হয়। এই সময়ে দেবী লক্ষ্মী গুণ্ডিচা মন্দিরের বাইরে একটি তেঁতুল গাছের কাছ থেকে এটি লক্ষ্য করেন। এরপর তিনি সেখান থেকে গোপনে অপর একটি পথে পুরীর মূল মন্দিরে ফিরে আসেন, ওই পথটি ❝হেরা গোহরী❞ পথ নামে পরিচিত৷ এই ভাবেই এই উৎসবটির মাধ্যমে দেবী মহালক্ষ্মীর তাঁর স্বামী জগন্নাথের উপর অভিমান ও ভালবাসা ফুটিয়ে তোলা হয়।
শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামিপাদ উক্ত উৎসবকে শ্রীলক্ষ্মীবিজয় উৎসব বলে উল্লেখ করেছেন। এই হেরা পঞ্চমী উৎসবের উল্লেখ স্কন্দপুরাণে পাওয়া যায়। পূর্বে হেরা পঞ্চমী মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে প্রতীকী উপায়ে পালিত হতো।
মা লক্ষ্মী তো রাগে অভিমানে শ্রী মন্দিরে ফিরে যান, কিন্তু উল্টো রথের পর যখন জগন্নাথ মন্দিরে ফিরে আসেন তখন লক্ষ্মীর সেবাইতরা মন্দিরের দ্বার বন্ধ করে প্রভুকে ঢুকতে দিতে চান না লক্ষ্মীর নির্দেশে। লক্ষ্মীদেবীর প্রতিনিধি সেবায়েতদের সঙ্গে জগন্নাথদেবের প্রতিনিধি দয়িতাপতিদের তর্কাতর্কি চলতে থাকে। তাই পত্নীর মানভঞ্জন করার জন্য শেষে এক হাঁড়ি রসগোল্লা মা লক্ষ্মীর জন্য মন্দিরে পাঠিয়ে তবে শ্রী মন্দিরে ঢোকার সুযোগ পান জগন্নাথ।
সৌজন্যে – শ্রী রামকৃষ্ণায়তে নমঃ