দেবিকা মিত্র : – সুরবালার বয়স হয়েছে অনেক তবু এখনও বদ বুদ্ধি গুলো যায় নি। কারোর বাড়িতে ঝগড়া হচ্ছে শুনলে ওমনি কান খাড়া করে ঝগড়ার কারণ শোনার চেষ্টা করেন। কেউ হয়তো লুকিয়ে কিছু কাজ করতে চাইছেন উনি ওমনি লুকিয়ে দেখেন, সে কি করছে বা কোথায় কি লুকিয়ে রাখছে ইত্যাদি ইত্যাদি।ওনার সব থেকে বড় খারাপ অভ্যাস হলো এর ওর কথা লাগানি ভাখানি করা। যার জন্য বাড়িতে লোক এসে ঝগড়া করে যায়, দুচার কথা শুনিয়ে যায় ।
ওনার একমাত্র ছেলের বৌ পলি! অনেকবার বারণ করেছে কিন্তু উনি সেসব কানে তোলেন না। কেবল এর ওর বাড়িতে ঘুরে বেড়ান আর সবার হাঁড়ির খবর জোগাড় করে চারদিকে বলে বেড়ান।
এই তো সেদিন, মল্লিক বাড়ির ছোটবৌ চম্পা পুকুর থেকে স্নান করে এক ঘড়া জল নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সুরবালার একেবারে মুখোমুখি। চম্পা যতো ওনাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায় উনি ততো ওর পিছন ছাড়েন না। উনি বলেন….,
হ্যাঁ রে চম্পা, শুনলুম নাকি তোর ছেলেটা এই বয়সেই বিড়ি খাওয়া ধরেছে। তা আমার চোখে পারেনি অবশ্য। ওই তো, দে বাড়ির মেজ গিন্নিই বলছিল। তা সে যে এই বয়সেই লায়েক হয়ে গেছে। এবার তো এই গ্রামের সব ছেলে পুলে ওর পাল্লায় পরে নষ্ট হয়ে যাবে….
কথা শেষ হতে না হতেই দে বাড়ির মেজ গিন্নি ওখান দিয়েই পুকুরে যাচ্ছিল। ওকে দেখতে পেয়েই চম্পা খপ করে ওর হাতটা ধরে বলে….,
হ্যাঁ গো মেজ গিন্নি! আমার ছেলে বিড়ি খাচ্ছে, একথা তুমি জানলে কি করে! তোমার ছেলে বলেছে বুঝি!! তা তোমার ছেলেও নিশ্চয়ই দু একটা টান মারে।নাকি তাতে টান মারতে দেয় নি বলে রাগ হয়েছে!! নাকি আমার ছেলে তোমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে টান মেরেছে!!
মেজ গিন্নি তো অবাক। হাঁ করে চম্পার কথা শুনছে কিন্তু কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। বলে….,
হ্যাঁ রে চম্পা, তোর যে এমন মাথার ব্যামো হয়েছে তা তো জানতাম না! দেখি বাবু ঠাকুরপোকে বলতে হবে এবার তোমার বৌয়ের চিকিৎসার প্রয়োজন।
এই নিয়ে দুইজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া লেগে যায়। সুরবালা, সেখানে আর বেশিক্ষণ থাকেননি বাড়িতে ফিরে আসেন ।
একটু পরেই চম্পা আর দে বাড়ির মেজ গিন্নি এসে সুরবালাকে যা নয় তাই বলল আর তার সাথে পলিকেও দুচার কথা শুনিয়ে গেল।
পলির খুব রাগ হয় ।শাশুড়িকে খুব বকাবকি করে তবে ও ভালো করেই জানে এই স্বভাব বদলাবার নয়।
আর একদিন, ঘোড়ুই বাড়িতে তুমুল ঝগড়া লেগেছে দুই বৌয়ের মধ্যে। এটা ওদের বাড়ির নিত্যদিনের ঘটনা। তবে এই দিনের ঝগড়াটা সুরবালাকে নিয়ে। সুরবালা নাকি ঘোড়ুই বাড়ির ছোটবৌ মালতীকে বলেছেন….,
তুই বাঁজা বলে, তোর বড় জা রাখি, সকালে উঠে তোর মুখ দেখতে চায় না। এমনকি তোর ভাশুর নাকি অফিস যাওয়ার আগে তোর মুখ দেখলে সেদিন বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ বসে তবেই অফিসে যান।
রাখি তো আকাশ থেকে পড়ে। বলে….,
ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এসব কি কথা রে ছোটবৌ!! এমন কথা মনে আনাও পাপ। তাছাড়া তুই তো একা বাঁজা নোস, আমিও তো বাঁজা। আমি সোনাকে দত্তক নিয়ে মা হয়েছি আর তুই সেটা করিসনি। চল আমার সাথে পিসিমার বাড়ি। পিসিমা মানে সুরবালা।
সেদিনও সুরবালা ওদের ঝগড়া শুনেছিল ওদের সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। যেই শুনেছে ওরা দুই জা ওদের বাড়ি আসছে,তখন ভয় পেয়ে যান সুরবালা। এবার পলি তো আর আস্ত রাখবে না। তাই ঘোড়ুই বাড়িতে বসেই সব মিটমাট করতে ঢুকে পড়েন সুরবালা।
কিন্তু ওরা দুই জা খুব ঝগড়ুটে ।ওনাকে কাছে পেয়ে বড় জা রাখি বলে….,
ও পিসিমা, কবে আপনাকে এমন কথা বলেছি বলুন তো!!
সুরবালা তখন ….
আসলে তুমি না আমি এসব বলে আমতা আমতা করতে থাকেন।
মালতী ছাড়বার পাত্রী নয় ।সে, সুরবালার হাত ধরে টানতে টানতে পলির কাছে আনে এর একটা বিহিত করার জন্য। সুরবালা তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। সেদিন পলির চেষ্টায় সুরবালা ওদের হাত থেকে রক্ষা পান ঠিকই কিন্তু পলি ওনাকে খুব বকাবকি করেন আর ওনার একমাত্র মেয়ে রীনাকে বলে দেবে বলে ভয় দেখায়।
আসলে রীনাকে, সুরবালা খুব ভয় পান। রীনা একবার ওনাকে ওদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে এমন আটকে দিয়েছিল যে ঘরের বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না। ঘরবন্দি জীবন যে উনি পছন্দ করেননা তাই ওর বাড়ি উনি যেতে চাননা।
এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটতে থাকে আর পলিও তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠে। মনে মনে ভাবে এই ভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। ওনাকে একটু ভয় দেখাতে হবে যাতে উনি কিছুটা হলেও বদলে যান।
সেদিন সুরবালার ছেলে নবীন বাড়িতে ছিল। বাড়ির টুকটাক কাজ করছে। পলি নিজের কাজে ব্যস্ত। এই সুযোগে সুরবালা বের হতে যাবেন এমন সময় পলির চোখে পরে যান আর ঘরে আটকে পরেন।
পলি দেখল এটাই মোক্ষম সময়। পলি নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে, ইচ্ছা করেই ওর বরের উদ্দেশ্যে বলে….,
নাহ আর পারা যাচ্ছে না। দিন দিন মা অতিষ্ঠ করে মারছেন। শোনো, তুমি বরং মাকে তোমার বোনের বাড়ি দিয়ে এসো। ওখানে বেশ জব্দে থাকবেন। রীনা একদম খেতে দেবে না, বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না। একটা ঘরে আটকে রাখবে আর বেশি কথা বললে ছাদের ঘরে আটকে রাখবে তাহলেই উনি জব্দ হয়ে যাবেন।
সুরবালার স্বভাব ওদের জানা। উনি যে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছেন সেটা ওদের বুঝতে বাকি নেই । তাই ওনাকে সব রকম ভাবে জব্দ করার কথা দুজনে আলোচনা করে।
সুরবালা আর ঠিক থাকতে পারেন নি। হুড়মুড় করে ঘরের দরজা ঠেলে ঘরের ভিতরে ঢুকে পলির হাত ধরে বলেন….,
আমাকে রীনার কাছে পাঠিয়ে দিও না আমি আর এমনটা করবো না ইত্যাদি ইত্যাদি।
পলি হাসতে হাসতে বলে….,
দেখুন, আপনার কেমন স্বভাব, সেই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনেছিলেন তো!!এই আড়িপাতা স্বভাবটা আপনি কিছুতেই ছাড়তে পারছেননা না!!
সুরবালা লজ্জায় জিব কেটে বলে। এ বাবা! আর এমনটা হবে না দেখে নিও।
পলি জানে এই স্বভাব এতো সহজে বদলাবার নয় তবু চেষ্টা চালিয়ে যায়।
সৌজন্যে – প্রতিলিপি