উল্টোরথের পরের দিন একাদশীর দিন জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা যে বিশেষ সজ্জায় সাজ্জিত হয়, তাকে বলা হয় ‘সুনা বেশ’ বা স্বর্ণবেশ। এ-দিন শ্রীমন্দিরের সামনে রথের ওপরই এই বেশ বদল হয়। আপাদমস্তক স্বর্ণালঙ্কারে সেজে স্বর্ণমণ্ডিত হয়ে ওঠেন জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রা। সোনার হাত পা চুল লাগানো হয়, বেনারসি বস্ত্র পরানো হয়, আর প্রচুর অলংকারে সাজানো হয় তাঁদের। এই সময় জগন্নাথদেবের হাতে থাকে শঙ্খ ও চক্র, বলরামের হাতে থাকে লাঙল।
কথিত আছে, জগন্নাথ-অঙ্গে স্বর্ণবেশের জাঁকজমকের সূত্রপাত ত্রয়োদশ শতকে উৎকলের রাজা অনঙ্গ ভীম দেবের আমলে। তিনি এই সময় জগন্নাথকে ‘উৎকলরাজ’, ‘জাতির রাজা’ প্রভৃতি অভিধায় অভিহিত করেন। রাজা অনঙ্গ ভীম দেবই রথযাত্রাকালে জগন্নাথকে রাজার মতো সোনাদানামণ্ডিত বিশেষ সজ্জায় সাজানোর ব্যবস্থা করেন। সেই সময় থেকেই এই বিশেষ সজ্জাটিকে ‘রাজবেশ’, ‘রাজরাজেশ্বর বেশ’, ‘রাজাধিরাজ বেশ’ প্রভৃতি নামেও অভিহিত করা হতে থাকে।
জগন্নাথ-অঙ্গে স্বর্ণবেশের জাঁকজমক আরও বিপুল পরিমাণে বাড়ে পনের শতকে রাজা কপিলেন্দ্রদেবের আমলে। দক্ষিণ দেশের এক রাজাকে পরাজিত করে একবার কপিলেন্দ্রদেব স্বদেশে ফেরেন প্রচুর সোনাদানা হীরে জহরত নিয়ে। তার পরিমাণ এত যে ষোলখানা হাতির পিঠেও তা বোঝা হয়ে ওঠে। তবে সে-সব রত্নরাজি বয়ে এনেও আপন রত্নাগারে ঢোকাতে দেননি কপিলেন্দ্র। সমস্তটাই উৎসর্গ করেন জগন্নাথের শ্রীচরণে। কারণ, তিনি মনে করেন, তাঁর এ-জয় জগন্নাথেরই কৃপা, জগন্নাথেরই অনুগ্রহের ফল। সেই বিপুল রত্নরাজি ঠাঁই পায় মন্দিরের রত্নাগারে। কপিলেন্দ্র শুধু আদেশ দেন যে, ওই রত্নরাজি দিয়ে তিন দেবদেবীর জন্য যথেচ্ছ সুদৃশ্য অলঙ্কার তৈরি করানো হোক। আর তাই দিয়েই সম্পন্ন হোক রাজাধিরাজের বিশেষ সাজ, ‘স্বর্ণবেশ’।
মন্দিরের সেই বিশাল স্বর্ণভাণ্ডার থেকে রাজার আদেশে স্বর্ণকার ও মনিকারেরা যে-সব সাজ-উপকরণ এবং অলঙ্কারসমূহ তৈরি করেন, তার একটি বর্ণনামূলক তালিকা :—
১. শ্রীহস্ত – সোনার হাত।
২. শ্রীপায়ার – সোনার পা।
৩. শ্রীমুকুট – সোনার সুদৃশ্য বড় মুকুট।
৪. শ্রীময়ূরচন্দ্রিকা – শ্রীকৃষ্ণের মাথায় যেমন ময়ূর পালক বাঁধা থাকে, তেমনি জগন্নাথের জন্য সোনার বন্ধনী সমেত সোনার ময়ূর পালক।
৫. শ্রীচুলপটি – কপালের সৌন্দর্য বাড়াতে সিঁথি থেকে কপাল অব্দি ঝোলানো পদক।
৬. শ্রীকুণ্ডল – ঝুলন্ত গোলকের আকৃতিবিশিষ্ট সোনার কর্ণকুণ্ডল।
৭. শ্রীরহুরেখা – মুখের চারপাশে পরানোর জন্য প্রায় বর্গাকার অলঙ্কার। এর উজ্জ্বলতা মুখের চারপাশে এক স্বর্গীয় দীপ্তি সৃষ্টি করে।
৮. শ্রীমালা – অনেক রকমের আকার ও নকশাযুক্ত মালা রয়েছে। যেমন:
৮.১. পদম মালা – পদ্ম আকৃতির মালা।
৮.২. সেভতি মালা – ছোট্ট সূর্যমুখী ফুলের আকার-বিশিষ্ট মালা।
৮.৩. অগস্তি মালা – চাঁদের আকার-বিশিষ্ট মালা।
৮.৪. কদম্ব মালা – সোনার কদম্ব দিয়ে তৈরি মালা।
৮.৫. কাঠি মালা – সোনার পুঁতি দিয়ে তৈরি মালা।
৮.৬. ময়ূর মালা – ময়ূর পালকের নকশা ও আকৃতিযুক্ত মালা।
৮.৭. চম্পা মালা – মালাটি একেবারে হলুদ চাঁপা ফুলের মতোই দেখতে।
৯. শ্রীচিতা – এটি তিন দেবদেবীর তৃতীয় নয়ন। সোনার তবকে আটখানি মহামূল্যবান রত্ন চোখের আকৃতিতে সন্নিবিষ্ট করে তিনটি শ্রীচিতা তৈরি করা হয়েছে। তবে জগন্নাথের শ্রীচিতাটির মধ্যিখানে চোখের তারার মতো করে বসানো রয়েছে অত্যুজ্জ্বল হীরে। এই হীরে তাঁর সত্ত্বগুণকে নির্দেশ করে। সুভদ্রার শ্রীচিতার মধ্যিখানে রয়েছে পান্না। এটি তাঁর রজঃগুণকে নির্দিষ্ট করে।
১০. শ্রীচক্র – সোনার সুদর্শন চক্র।
১১. শ্রীগদা – সোনার গদা।
১২. শ্রীপদ্ম – সোনার পদ্ম।
১৩. শ্রীশঙ্খ – রূপোর শাঁখ।
এছাড়া আরও প্রায় শ’দেড়েক নানান নামের নানান আকারের অলঙ্কার রয়েছে, যেগুলো ব্যবহার করা হয় না বা বেরই করা হয় না মন্দিরের রত্নভাণ্ডার ‘ভিতর ভাণ্ডারঘর’ থেকে। যেটুকু বের করা হয়, তারই ওজন প্রায় দুই কুইন্টাল বা তার কিছু বেশি।
উপরোক্ত অলঙ্কারের তালিকা দিয়েই বছরের পর বছর ধরে তিন দেবদেবীর স্বর্ণবেশ হয়ে আসছে। বেশকর্ম শুরু করার ঠিক এক ঘন্টা আগে প্রভূত সশস্ত্র প্রহরীদের নজরদারিতে এই সব অলঙ্কারমালা পুষ্পালক ও দয়িতাপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ-সময় তিন রথ পর পর সিংহদুয়ারে অবস্থান করে। নিজ নিজ রথে অধিরূঢ় তিন দেবদেবী। তখন সদলে সেখানে এসে দয়িতাপতিদের নির্দেশে পুষ্পালকেরা প্রথমে তিন দেবদেবীর হাত-পা প্রভৃতি অঙ্গ সংস্থাপন করেন। তারপর একে একে দ্রুত হাতে আপাদমস্তক পরিয়ে দেন রত্নখচিত অঙ্গশোভন সুবর্ণ-অলঙ্কারমালা। জগন্নাথের ডান হাতে দেন সোনার সুদর্শন, বাম হাতে রূপোর শঙ্খ। বলভদ্রের বাম হাতে দেন সোনার লাঙ্গল, ডান হাতে সোনার গদা। আর দেবী সুভদ্রাকে দেন পদ্মের ভার। সেও সোনার।
‘স্বর্ণবেশ’ আষাঢ়ের শুক্ল একাদশীতে রথযাত্রার সময় যেমন অনুষ্ঠিত হয়, তেমনি বছরের অন্যান্য সময়ে আরও চার বার অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। বিজয়া দশমী, কার্তিক পূর্ণিমা, পৌষ পূর্ণিমা ও মাঘ পূর্ণিমার দিন। তবে তফাৎটা হচ্ছে, এই চারদিন মন্দিরের ভেতর রত্নবেদীর ওপর জগন্নাথেরা ‘স্বর্ণবেশ’ ধারণ করেন; আর আষাঢ়ে মন্দিরের বাইরে, রথের ওপর।