Select Language

[gtranslate]
৩০শে পৌষ, ১৪৩১ মঙ্গলবার ( ১৪ই জানুয়ারি, ২০২৫ )

।। মাতৃত্ব ।।

অপালা মুখার্জী :- শুকনো লঙ্কাপোড়া আর কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে তরিজুত করে পান্তাভাতটুকু মেখে সন্ধ্যার আধো – অন্ধকারে বসে গোগ্রাসে রাতের আহার সেরে নিচ্ছিলো ভোগলু। কুপির আলোয় কাঠের উনুনে কাঠকুটো জ্বেলে গোটাকয়েক মোটা রুটি সেঁকছিল পুনম – নিজের আর তার চোদ্দো বছরের মেয়েটার জন্য। তাদেরও রুটির সাথে বরাদ্দ ওই কাঁচা পেঁয়াজ আর একটুখানি রসুনের আচার। ভোগলুর রাতে রুটিতে পোষায় না।

ঘরের মধ্যে একচিলতে সরু তক্তাপোশে শুয়ে আছে বিজলী – ওদের একমাত্র কন্যাসন্তান । সন্তান মানুষের কাছে বিধাতার আশীর্বাদ – কিন্তু এই মেয়ে তাদের কাছে অভিশাপ। চিরজীবন এই বোঝা তাদের বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তারপর ? তারপরের কথা ঈশ্বর জানেন।

বিজলী শরীরেই ভর – ভরন্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু তার মস্তিষ্ক কোনো পরিণতিই পায় নি। জান্তব ক্ষুধা , ক্রোধ আর অসহায় ক্রন্দন – এগুলোই তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ । গরীবের ঘরে এমন অভিশাপ যে কেমন করে আসে – ভেবে কুলকিনারা করতে পারে না পুনম। অভাবের সংসারে মেয়ের জান্তব খিদের সামগ্রী যোগান দিতে না পেরে ওই অবোধ মেয়েটাকে নিষ্ফল ক্রোধে সে মাঝে মাঝে মারধোরও করে। পরক্ষণেই তার মাতৃস্বত্ত্বা নিজের ভুল বুঝে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার আর কি দোষ – সারাদিন ইঁটভাঁটায় অক্লান্ত খাটুনি আর অভাবের সংসারটাকে কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে দাঁড় করাতে গিয়েই তার জীবন আস্তে আস্তে পড়ন্ত বেলায় ঢলে পড়ছে ! এই মেয়ের ভবিষ্যত চিন্তা করতে গিয়ে তার মাঝে মাঝে মনে হয় , এমন সন্তান পৃথিবীর আলো না দেখলেই বা এমন কি ক্ষতি হতো !

ভোগলু পেশায় সাপুড়ে। তবে সে অন্য সাপুড়েদের মত সাপখেলা দেখায় না । সে সাপ ধরে। সাপের বিষ থেকে বহু মূল্যবান ওষুধ তৈরি হয় , সেইসব ওষুধের কোম্পানিতে সে কেউটে, গোখরো , কালাচ সাপের মত বিষধর সাপ পৌঁছে দেয়। তার পূর্বপুরুষ সাপখেলা দেখিয়েই খুন্নিবৃত্তি করতো , এই আধুনিক পেশার সাথে তাদের পরিচয় ছিলো না।দিনের চাইতে বেশি রাতেই সে সাপ ধরে। অন্ধকারের জীব অন্ধকারেই বেশি স্বচ্ছন্দ। আজও এই পরিতৃপ্তির খাওয়া সেরে সে সাপের খোঁজেই বেরোবে। এই সাপেরা তার স্ত্রী – কন্যার মতোই এখন এই পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বারান্দার এককোণে কিংবা ঘরের কোণায় বেতের ঢাকনা পরা ঝুড়িতে তারা বেশ কিছুদিন এই বাড়ির বাসিন্দা হয়ে থাকে , তারপরে তাদের বিষদাঁত ভেঙে সংগ্রহ করা হয় হলাহল – যা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বদলে যায় জীবনদায়ী অমৃতে।

-” পুনি , আমার ঝোলাটা দে ! আর , বড়ো টর্চখানা দিতে ভুলিস না যেন ! রাত ভালোই হলো – তোরাও মায়ে – বেটিতে খাওয়া সেরে দোর দিয়ে দে ! আমার ফিরতে ফিরতে রাত দু পহর তো হবেই ! সাড়া নিয়ে দোর খুলিস যেন!”

রুটি সেঁকা শেষ – ঘর্মাক্ত কলেবরে উঠে দাঁড়ায় পুনম। তার মুখে আশঙ্কার ছাপ।

-” তুমি রোজ রেতের বেলায় ওই যমদূত ধরতে যাও , আমি ভয়ে মরি ! একেই তো ওই অপোগণ্ড মেয়েটারে নিয়ে ঘর করি – ডাগর হয়ে উঠেছে মেয়েটা ! রাত বিরেতে ঘরের আশেপাশে শেয়াল কুকুর ঘুরে বেড়ায় ! কি জানি কপালে কি আছে !”

-” তুইও ভয় পাচ্ছিস , পুনি ? বেদিয়া – সাপুড়ের ঘরের মেয়ে তুই । বিপদের আভাস পেলেই ফণা তুলে দাঁড়াবি ! মা জগৎগৌরীর ছানাপোনারা তো আমার ঘরের লোক ! তুই বিপদে পড়লে তারা কি তোকে রক্ষা করবে না ! এটুকু বিশ্বেস রাখ ! কিছু হবে না আমাদের বিজলীর !” কাঁধের বাঁকে বেতের ঝুড়ি তুলে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ভোগলুর বলিষ্ঠ দেহখানা।

ঘরের মধ্যে জান্তব চিৎকারে মাকে ডেকে ওঠে বিজলী। তার খিদে পেয়েছে ! তাড়াতাড়ি একখানা কলাইকরা সানকি টেনে নেয় পুনম। গোটা তিনেক মোটা রুটি আর খানিকটা রসুনের আচার ঢালে তাতে। সরু তক্তাপোশে মেয়ের পাশে গিয়ে বসে। লম্ফের আলোয় আবছা আঁধার ঘরে খাবারের থালা দেখে সাগ্রহে উঠে বসে বিজলী। ওই জান্তব অনুভূতিটুকুই তো তার সম্বল ! লোভে তার মুখ দিয়ে লাল – ঝোল গড়িয়ে পড়ে। আধো অন্ধকার ঘরে তাকে দেখে মনে হয় যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ ! সযত্নে মেয়ের মুখ মুছে রুটির টুকরো ভরে দেয় পুনম। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় তার দুচোখ জলে ভরে আসে। ঈশ্বরের দরবারে কি এমন অপরাধ করেছিলো তার মেয়েটা – যার জন্য তার এই শাস্তি ? আবোল তাবোল চিন্তায় হারিয়ে যায় তার মনটা। খেয়েদেয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে ঘুমিয়ে পড়ে বিজলী। আলো – আঁধারিতে বড়ো মায়াময় দেখায় তার মুখখানা । কি নিষ্পাপ সেই মুখ ! সেদিকে তাকিয়ে সেরাতে ভালো করে খাওয়াও হয় বা পুনমের । গত কয়েক রাতেই সে তার ঘরের পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছে। মেয়েটা মনে না বাড়লেও শরীরে যে তার প্রস্ফুটিত যৌবনের বান ডেকেছে ! নারীমাংসলোভী হায়নার দল এই পৃথিবীতে তো কম নেই ! ঘুমন্ত মেয়েটাকে এক হাতে বুকের কাছে টেনে নিয়ে অন্যহাতে হেঁসোটা বালিশের নীচে গোঁজে পুনি । কয়েকদিন ধরেই ভাঁটার কুলি সর্দার রহমত শেখকে এই পাড়ায় ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে সে। মেয়েদের নেশা রহমতের বহুদিনের। এখানে নিশ্চয় সে নতুন কাউকে খুঁজে পেয়েছে !

সকালে খেমি বুড়ি বিজলীর ঘরে থাকে। নাহলে ওই অপগণ্ড মেয়েটাকে দেখাশোনা করবে কে ? তাকে তো পেটের দায়ে বেরোতেই হয় ! খেমি গ্রামসম্পর্কে ভোগলুর ঠাকুমা হয়। তিনকুলে কেউ নেই – এই সংসারেই দুমুঠো ভাত পায়। রহমত অত্যন্ত কুৎসিত চরিত্রের লোক। পুনমকেও সে অনেক অশ্লীল ইঙ্গিত করেছে – কিন্তু পুনম যখন ভাঁটায় যায়, তার কোমরের খুঁটে লুকোনো থাকে ধারালো ছুরি , এটা তার জানা !

গতকাল নাকি রহমত দুপুরে একবার এই বাড়ির জানলায় এসে দাঁড়িয়েছিল। খেমিবুড়ির কোমর ভাঙ্গা – সে জোরে চলতে পারে না। জানলায় অচেনা লোক দেখে তাকে গালিগালাজ করতে করতে সে যতক্ষণে জানলার কাছে বিজলীর পাশে গিয়ে পৌঁছয় , ততক্ষণে রহমত সেখান থেকে চলে গেছে। বিজলী একখানা কাঠি আইসক্রিম চুষছিল , তার লাল – ঝোল মাখা চেহারাতে অপরিসীম আনন্দ ফুটে উঠেছিলো। বুড়ির আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না , আইসক্রিম টেনে নিয়ে সে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয় । আর সেই ক্রোধে বিজলী তাকে জন্তুর মত মারে। ব্যথায় কোমর নাড়াতে পারেনি বুড়ি , তাই সে আজ আসেনি – পুনিরও আর ভাঁটায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

ঘরের কোণায় দুটো বেতের ঝুড়িতে কেউটে আর খরিশ গোখরোর ক্রুদ্ধ ফোঁসফোঁস আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাপুড়ের মেয়ে পুনম – ও আওয়াজ তার কানে সওয়া! কাল তাদের নিয়ে ভোগলু শহরে যাবে – এই দুর্মূল্যের বাজারে হাতে দু চার টাকা আসবে।

পুনম চিন্তার জাল বুনেই চলেছিল। মেয়েটা মাকে আঁকড়ে ধরে এখন আর পাঁচটা মেয়ের মতোই পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে । মাঝে মাঝে বড়ো অপরাধী লাগে নিজেদের – পয়সার অভাবে মেয়েটার চিকিৎসা পর্যন্ত হলো না !

বাঁশের দরজাটা নড়ে উঠলো যেন! তবে কি অন্ধকারের আড়ালে হায়নাগুলো তাদের ইন্দ্রিয়ের খিদে মেটাতে এসেছে ? পুনমের মাতৃসত্ত্বার প্রতিটি অণু পরমাণু সজাগ হয়ে ওঠে। সন্তর্পণে বালিশের নীচে থেকে হেঁসোটা তুলে নেয় সে। মড়ার মত পড়ে থাকে – যেন গভীর ঘুমে মগ্ন ! মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে !

অন্ধকারেরও নিজস্ব একটা আলো থাকে – সেই আলোয় এক ছায়ামূর্তিকে ঘরে ঢুকতে দেখা গেলো। মুখখানা তার কালো কাপড়ে ঢাকা। নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে পুনম। ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগোয়। মুঠি শক্ত করে হেঁসোটা আঁকড়ে ধরে পুনম।

বিজলীর পাশে এসে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায় ছায়ামূর্তি । বোধ হয় নিশ্চিন্ত হতে চায় – সে ঘুমোচ্ছে কিনা ! তারপরেই ক্ষুধার্ত জন্তুর মত উপুড় হয়ে পড়ে ওই অসহায় বোধবুদ্ধিহীন মেয়েটার ওপরে ! আচমকা ঘুম ভেঙে গিয়ে বিজলী আহত বণ্য জন্তুর মত তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে – রাতের অন্ধকারে নৈঃশব্দ্য ভেঙে সেই চিৎকার দূর থেকে দূরে প্রতিধ্বনিত হয়! আর , ঠিক তখনই পুনমের পায়ের ধাক্কায় খুলে যায় বিছানার পাশে রাখা বেতের ঝুড়ির ঢাকনা। সেখান থেকে ফণা বিস্তার করে জেগে ওঠে মূর্তিমান মৃত্যুদূতেরা! স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে পুনম। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ছায়ামূর্তির পা জড়িয়ে ধরে মা জগৎগৌরীর সন্তানেরা। তাদের শীতল স্পর্শে সম্বিত ফেরে ছায়ামূর্তির । কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে ! ভয়ে এবার মুখের ঢাকা টেনে খোলে ছায়ামূর্তি । কালসর্প বিশাল ফণা বিস্তার করে সোজা হয়ে ওঠে। তখনই পুনম আততায়ীর মুখ স্পষ্ট দেখতে পায়। রহমত – রহমত এসেছে তার অসহায় মেয়ের ইজ্জত লুটে নিতে!

আহত নাগিনীর মত ফুঁসে ওঠে পুনম ! বিজলী বিছানার এককোণায় বসে থরথর করে কেঁপে যাচ্ছে! মাঝে মাঝে জান্তব চিৎকারে কাকে ডাকছে , কে জানে !

-” ছোড় দে মুঝে পুনিয়া ! মাফ কর দে ! ” অসহায় কান্না কেঁদে ওঠে রহমত।

খলখল করে উন্মাদিনীর মত হেসে ওঠে পুনম। তার ছিপছিপে চেহারাখানা ফনাধারী সর্পিনীর মত দুলতে থাকে। একইসাথে রহমতের শরীরে আঘাত হানে দুই কালনাগিনী ! ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। দেওয়াল যেন হোলির রঙে রঙিন ! ছুটে গিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা – ঠিক যেন পক্ষীমাতা তার শাবককে ডানার আড়ালে লুকিয়ে নিয়ে পৃথিবীর সব বাধা বিপত্তির হাত থেকে বাঁচাতে চায় ! মায়ের বুকে পরম নিশ্চিন্তে মুখ লুকোয় মেয়ে! নিষ্প্রাণ রহমতের দেহ পড়ে থাকে মাটির ওপরে। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে ভোগলু – তার পায়ের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বাইরে চলে যায় তার মেয়ের পরিত্রাতা । হতবাক হয়ে যায় ভোগলু । উন্মাদের মত কেঁদে ওঠে পুনম !

রাত ফুরিয়ে ভোর হয় – এ ভোর যেন অন্য ভোর ! পুলিশের সাথে তাদের জীপে ওঠে নিরক্ষর এক নারী – ইজ্জতের দাম যার কাছে প্রাণের চাইতেও বেশী । অপগন্ড মেয়েটা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু না বুঝলেও আজ তার চোখে জল !

-” কাঁদিস না বিজলী ! আমরা জাত সাপুড়ে। প্রয়োজনে নিজেকে রক্ষা করতে ছোবল মারতেই হয় ! আমি দোষী নই মা – সমাজের এক আবর্জনাকে সরিয়ে দিলাম শুধু ! আমি ফিরে আসবো – ততদিন বাপের ছায়ায় বাঁচিস মা !”

গাঁয়ের বাঁকে গাছপালার আড়ালে মিলিয়ে গেলো জীপখানা। সেই জীপ থেকে যতদূরে দেখা যায় – সেদিকে আকুল চোখে তাকিয়ে থাকলো এক চিরন্তন মা , যার কাছে সন্তানের মূল্য তার নিজের জীবনের চাইতে অনেক – অনেক বেশি !

Related News

Also Read