Select Language

[gtranslate]
৩০শে পৌষ, ১৪৩১ মঙ্গলবার ( ১৪ই জানুয়ারি, ২০২৫ )

।। উপলব্ধি ।।

গৌতম নারায়ণ দেব :- তখনও বিয়ের দুটো মাস পেরোয় নি। অফিস থেকে বাড়ী ফিরে গিন্নির মুখটা ওরকম ভার হয়ে থাকতে দেখে সমিত যেই না জিজ্ঞেস করল,” কী হলো,সুপ্তি। কথা বলছো না যে। কিছু হল নাকি আবার?”
মিনিট দুয়েক কোন কথাই না বলে শেষে সুপ্তি বলল, “কী আবার হবে? যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।”

-“আরে খোলসা করে বলো না। তোমার ওই হেঁয়ালিভরা কথা না আমি বাপু বুঝতে পারি না।”

-” আর বুঝে কাজ নেই।”

গিন্নির এই একগুঁয়েমিতে সমিতও এবার খুব বিরক্ত হল। “ঠিক আছে তোমার বলতে হবে না”- এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,”আজ বাড়ীতে কিছু হয়েছে নাকি মা? সুপ্তি মুখটা গোমড়া করে রয়েছে।”

-“আজ দুপুরে তোর ছোটমা’র শরীরটা খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। পেটে অসম্ভব ব্যথা। ঘরে যা ওষুধ ছিল, তা দেওয়া সত্ত্বেও কিছুতেই যখন কমে না,তখন সুপ্তিই গিয়ে তমাল ডাক্তারকে বাড়ীতে ডেকে নিয়ে আসে। ওনার ওষুধ খেয়েই ওর ব্যথাটা কমল। এখন একটু ঘুমোচ্ছে।”

অফিস থেকে ফিরে তখনও সমিত ফ্রেশ হতে পারে নি । তৎক্ষণাৎ ছুটল দোতলায় ছোটমা’র ঘরে। কাকু তখনও ফেরে নি অফিস থেকে। যদিও রাত ন’টার আগে কোনদিনই তিনি ফিরতে পারেন না। যাই হোক, ছোটমাকে ও আর জাগালো না। গায়ে হাত-ঠাত দিয়ে দেখল জ্বর আছে কিনা। তারপর নিজের ঘরে ফিরে আসল।

ফ্রেশ হওয়ার পর চা খেতে খেতে সুপ্তিকে কাছে ডাকল সমিত। ওর বিরক্তিবোধটা তখন অনেকটাই স্তিমিত।

“শোন, সুপ্তি, তোমার মুখ থেকে প্রায়ই এই ধরনের কথা শুনতে আমার না আর ভালো লাগে না,বুঝলে তো? আমি তো কিছু লুকিয়ে বিয়ে করিনি। সবটাই তো তুমি জানতে। আর ঘরের কোন কাজ তো তোমাকে নিজে করতে হচ্ছে না। কাজের লোক থেকে রান্নার লোক -সবই তো আমাদের আছে। তোমাকে শুধু ডাক্তারটা ডেকে আনতে হয়েছে। তাও বাবা পিসির বাড়ীতে না গেলে সেটুকও হয়তো তোমায় করতে হত না। কেননা ওই সময়টাতে বাবা সাধারনত বাড়ীতেই থাকেন।”

-“তোমার এই যুক্তিগুলো তো সবই ঠিক। কিন্তু, একটা মেয়ের দিক থেকেও তো ব্যাপারটা বুঝতে হয়। মানুষ একটা করে শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়েই পারে না, সেখানে আবার দু-দুটো করে। একজন নতুন বউ কী করে এইসব সামাল দেয়? তাঁর কাছে যখন দায়িত্বগুলো বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, বিরক্তির এই প্রকাশটুকু তখন খুবই স্বাভাবিক। মানুষ তো আর সবসময় যুক্তি-ব্যাখ্যা দিয়ে সংসার করতে পারে না। তাঁর মধ্যে রাগ,বিরক্তি আসবেই। আর সেগুলো যখন আসবে,এইভাবেই সে তা প্রকাশ করবে। বুঝলে?”

-“যাক গে, তোমার সাথে আর এই ব্যাপারে আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি তো এখন ইচ্ছে করলেই কাকু আর ছোটমা’র সংস্রব ত্যাগ করতে পারবো না। কী করে আমি ভুলব ওদের অবদানের কথা? আজ আমি যেখানে এসে পৌঁছেছি,সেটা কি কখনও সম্ভব হত যদি না ওরা আমার দায়িত্ব নিত।”

-“দেখো,ওটা একান্তই তোমাদের সংসারের নিজস্ব ব্যাপার। তার হ্যাপা সারা জীবন ধরে আমি কেন সহ্য করতে যাবো?”

-” হ্যাঁ,ঠিকই বলেছো ওটা আমাদের সংসারের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। তবে এটাকে হ্যাপা হিসেবে দেখাটাও তোমার ঠিক হচ্ছে না। সব সংসারেরই একটা ইতিহাস থাকে। আমাদেরটা না হয় একটু অন্যরকম। সেই সব দিকগুলোও তো পর্যালোচনা করতে হয় কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে। ধরো না, আইনমাফিক আজ তো আমার কাকু-ছোটমা’র কাছেই থাকার কথা। সেটা করলে কি আমার বায়োলজিক্যাল বাবা-মায়ের প্রতি সুবিচার করতে পারতাম?”

এই কথাগুলো যখন সমিত বলছে, সুপ্তির মধ্যে মনে হল একটু অবস্থান্তর হচ্ছে। ও জিজ্ঞেস করল,”তোমার মা-বাবা একেবারে লেখাপড়া করে কী করে তোমায় দিয়ে দিতে পারলো কাকুদের হাতে?”

“ঠিকই। অনেকেই হয়তো অবাক হবে এই কথা শুনে। আর তাঁদের অবাক হওয়ার মধ্যেও হয়তো কোন অস্বাভাবিকতা থাকবে না। কিন্তু পরিস্থিতিটা যদি ভালোভাবে বিচার করা যায়,তাহলে এটা মেনে নেওয়াটাও হয়তো তাঁদের পক্ষে অনেক সহজ হয়ে উঠবে।”

-“কী এমন পরিস্থিতি হল যে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে হল?”
-“দেখো, এটা ঠিক দুয়ে-দুয়ে চারের মতন নয়। অনেকগুলো কারণ একসাথে কাজ করলে ঠিক অঙ্কের নিয়মে তার উত্তর না পাওয়াও যেতে পারে,যদি মানুষের মন বলে যে জিনিসটা থাকে সেটা যুক্ত থাকে। যেমন, আমাদের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল, বাবার অর্থনৈতিক অসচ্ছলতাটাতো ছিলই একটা কারণ। তারপর ছিল কাকুদের ওপর আমাদের সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা, কাকুদের নিঃসন্তান জীবনযাপন, সর্বোপরি আমার প্রতি তাঁদের অত্যধিক স্নেহ। অনেকে হয়তো এটাকে একটু অস্বাভাবিকই ভাববে যে মায়ের থেকে বুঝি মাসির দরদ বেশী। আমার ক্ষেত্রে বেশী না হলেও একই রকমের ছিল-এটা কিন্তু বলা যেতেই পারে। আর একটা কথাও বলা দরকার, আমার একটা দিদি থাকার দরুণ মা-বাবার কাছে তখনও কিন্তু একটা অবলম্বন ছিল।”

-“তা ওনারা তো তোমার দিদিকেও নিতে পারতেন?”

-“হ্যাঁ, সেটা ঠিকই বলেছো। দিদিকে দত্তক নিতে পারতো। কিন্তু দিদি তখন বেশ বড় হয়ে গিয়েছে,মানে কাকুরা যখন জানতে পারলো যে তাঁদের সন্তান হওয়ার আর কোনই সম্ভাবনা নেই, দিদির তখন বছর দশেক বয়স আর আমার তিন। ও তো মা-বাবা ছাড়া কারোর কাছেই তখন থাকবে না। ও বলেই দিয়েছিল ও মা-বাবাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবে না। আর জন্মের পর থেকেই আমিও হয়ে পড়েছিলাম ওদের একেবারে ন্যাওটা। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে মা-বাবার কাছে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবধি কাকুদের ঘরেই আমি থাকতাম। কাকু আর ছোটমা দুজনেই অসম্ভব ভালোবাসতো আমায়। একটু বড় হওয়ার পরে মাকেও অনেকসময় বলতে শুনেছি ছেলেটাকে আদরে একেবারে বাঁদর করে ছাড়ল। যাই হোক, একদিন কাকু এসে বাবাকে বলল,’দাদা, তুমি যদি কিছু মনে না করো আমি একটা প্রস্তাব তোমায় দিতে পারি। চাকরিটা চলে যাওয়াতে তোমার তো এখন খুবই অসুবিধে। আমি যদি অমির দায়িত্বটা পুরোপুরি নিই,তোমার কি কোন অসুবিধে আছে?’
বাবা ব্যাপারটা পুরোটা বুঝতে না পেরে তখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘পুরোপুরি বলতে?’
কাকু উত্তরে জানিয়েছিল,’পুরোপুরি বলতে একেবারে আইনমাফিকভাবে যদি সমিকে দত্তক নিই?’ ও তো তোমারই থাকবে। দত্তক নিলে আমাদের একটা বাড়তি সুবিধে হবে। সেটা হল আমার অফিস থেকেও ওর পড়াশোনা বা অন্যান্য ব্যাপারে অনেক সুযোগ-সুবিধা আমি পেয়ে যাবো। দেখো, কোন তাড়াহুড়ো নেই।সময় নিয়ে তুমি ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখো।’

বাবা সেই মুহূর্তে তো কোন উত্তর দেয়ই নি। বরং দু-তিনমাস এ বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্যই করে নি। শেষে মায়ের সাথে অনেক আলাপ-আলোচনা করে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ওরা রাজি হয়েছিল। যদিও শর্তগুলোতে কোন আইনগত সিলমোহর ছিল না। সবটাই ছিল পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর। যেমন, একবেলা আমি মায়ের কাছে খাবো, দুপুরে মায়ের কাছে শোব-এইরকম আর কী।”
সুপ্তি তো এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত সমিতের কথা সব শুনছিল। একসময়ে ও বলেই ফেলল,”এ তো দেখছি রুপোলি পর্দায় ঘটে যাওয়ার মত সব ঘটনা। তা আমি তো শুনেছি তোমরা নাকি অনেকদিন এই বাড়ীতেই ছিলে না তোমার কাকুর বদলি হয়ে যাওয়ার পর। সম্ভবত দিল্লিতে চলে গিয়েছিলে? তা ওই সময় তো তোমার গর্ভধারিনী মায়ের খুবই কষ্ট হয়েছিল?”

-” হ্যাঁ, তা তো হয়েই ছিল। ওই চিঠির মাধ্যমেই খোঁজ-খবর নিতাম। তখনও তো মোবাইল চালু হয় নি।”

এবারে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুপ্তি বলল, “বুঝলাম। মোটামুটি একটা মিনি মহাকাব্য।”

ইতিমধ্যে ওদের বিবাহ-বার্ষিকীর দিনটাও চলে আসল। সেখানেও বিশাল আয়োজন। অমিত খরচ-খরচা দিতে গেলে ওর কাকু একটা পয়সাও নিলেন না। সম্পূর্ণ নিজের খরচে বাড়ী ভাড়া করে প্রায় আড়াইশোর মত অতিথি নেমন্তন্ন করে এই বিশেষ দিনটা উদযাপিত হল। অনুষ্ঠানের আগের দিন আবার সুপ্তিকে সাথে করে ছোটমা নিয়ে গেলেন জুয়েলারি শপে। ওর পছন্দমত একটা সোনার ব্রেসলেটও কিনে দিলেন। এসব দেখে সুপ্তি তো তখন রীতিমত বাকরুদ্ধ। এ তো ওর কল্পনাতেও কখনও ছিল না। এমন কী,গাড়ী করে আসার সময় ছোটমা যখন ওকে বলল, “সুপ্তি, তোর পছন্দ হয়েছে তো? দেখ্, এটা কিন্তু তোর কাকু দেয় নি। সম্পূর্ণ আমার টাকায়,বুঝলি তো? শোন, আজ আমি তোকে বলি, সমি যদি তোর কাকুর ছেলে হয়, তুই হলি গিয়ে আমার মেয়ে। যবে থেকে তুই এই বাড়ীতে এসেছিস, একেবারে সেই দিনটা থেকেই তোকে আমার এত ভালো লেগে গেছে না, সুপ্তি, তা আমি তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। বিশ্বাস কর,আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না।”
ছোটমা’র থেকে স্নেহমাখা এই প্রশস্তি শুনতে শুনতে সুপ্তি তো একেবারে আহ্লাদে আটখান হয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল।

তারপর কয়েকটা বছর কেটে গেছে। সুপ্তিও এখন অনেক পরিবর্তিত। শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকের, বিশেষ করে ছোটমা’র ভালোবাসাটা এখন ও বেশ ভালোরকমই অনুধাবন করতে পারে। বাড়ীর সবাই অবাক হয়ে শুধু দেখতো ও যখন ছোটমা’র সেবা করত, উনি যখন শয্যাশায়ী ছিলেন। মানে ওনার ওই পেটের ব্যাধিটাই যখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। বেশীরভাগ সময়েই তখন সুপ্তিকে দেখা যেত ওনার বিছানার পাশে ঠাঁয় বসে রয়েছে। এমন কী, একবার সরাসরি রক্তদানের প্রয়োজন হলে সুপ্তি নিজে রক্ত দিতে উদ্যোগী হয়। ওদের মধ্যেকার অদৃশ্য টানের প্রকাশটা হয়তো এভাবেই দুজনের রক্ত-মিশ্রনের মাধ্যমেই ফুটে উঠেছিল। কাকতালীয়ভাবে দুজনের রক্তের প্রকৃতি, অর্থাৎ গ্রুপ ও অন্যান্য ফ্যাক্টরও ছিল হুবহু এক।

কিন্ত, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জাগতিক মায়া কাটিয়ে ছোটমা পাড়ি দিলেন ‘না ফেরার দেশে’। কী আশ্চর্য,শরীরের ভাবগতিক দেখে মাত্র মাস তিনেক আগেই ব্যাঙ্কে গচ্ছিত নিজস্ব টাকাপয়সার সবটাই তিনি সুপ্তির সাথে যৌথভাবে করে রেখেছিলেন। এতটাই ভালোবাসতেন ছোটমা সুপ্তিকে।

Related News

Also Read