Select Language

[gtranslate]
২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ শনিবার ( ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৫ )

।। ভুল ।।

শতরূপা দত্ত :- আমি সুদীপ। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুলটা আজ বুঝতে পেরেছি। পিয়াসীর মতো একটা মেয়েকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে খুব ভুল করেছি।

আজ থেকে সাত বছর আগে বাবা মায়ের পছন্দ মতো তিন্নিকে বিয়ে করেছিলাম।আমাদের একটা ফুলের মতো মেয়ে আছে।
তিন্নি খুব ভালো একটা মেয়ে। যে সংসারে সবার খেয়াল রাখে। আমাদের বাচ্চা মেয়ে ফুলঝুরি, আমার বাবা, মা সবার খেয়াল ওই রাখতো। আমি শুধু নিজের অফিস আর কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। ওকে সেভাবে সময় দিতে পারতাম না। তারপর আমার প্রোমোশন হোলো। ট্রান্সফার হলাম দিল্লীতে। বাবা মা কে ছেড়ে ও আমার সাথে দিল্লী আসতে চাইলো না। আমিও আর জোর করলাম না। দিল্লীতে আমি পিয়াসীর সাথে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পরলাম।

প্রথম প্রথম মাসে একবার বাড়ী ফিরতাম। পরে আর নিয়মিত বাড়ী ফিরতে পারতাম না। পিয়াসীর সাথে সময় কাটাতেই বেশী ভালো লাগতো। তাই ছুটি পেলেও বাড়ীতে না ফিরে দিল্লীতে পিয়াসীর সাথে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, বার কিংবা নাইট ক্লাবে যেতাম। পিয়াসী ক্রমশ আমার একটা নেশায় পরিনত হলো। আমার খরচ বাড়তে লাগলো। বাড়ীতে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলাম। ফোন করে বাড়ীতে জানিয়ে দিলাম আমি তিন্নিকে ডিভোর্স দিতে চাই। বাবা মা ফোন করে আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তখন আমি পিয়াসীর মোহে অন্ধ হয়ে ছিলাম। তাই ওদের জানিয়ে দিলাম যে আমার উকিল ডিভোর্সের পেপার নিয়ে গেলে যেনো তিন্নি সই করে দেয়।

খুব শিঘ্রই আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেলো। পিয়াসীকে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে এলাম। পিয়াসী কিছুতেই বিয়ে করতে চাইলো না। ও লিভ টুগেদারে বিশ্বাসী। ওর সবরকম আবদার মেটাতে মেটাতে আমি বিভিন্ন জায়গায় ধার করতে লাগলাম। এমনকি ওর আবদারে আমার ফ্ল্যাট ওর নামে লিখে দিলাম।

কিন্তু কিছুদিন পরে থেকেই লক্ষ্যে করলাম ও আমাকে আর সেভাবে সময় দিতে পারছে না। বেশ কিছুদিন লক্ষ্য করার পরে আমি ওর মুখোমুখি হলাম। সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলাম ওর এই ব্যবহারের কারণ।

ও একটু ও সংকোচ না করে স্পষ্ট করেই আমাকে জানিয়ে দিলো ও অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছে। আর আমার সাথে থাকতে চায় না।

অনেক অনুরোধ করলাম। বললাম ~ আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। প্লিজ তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না পিয়াসী। তোমার জন্যে আমি আমার বিয়ে করা বৌ কে ছেড়েছি। আমার ফুলের মতো বাচ্চাকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছি।

ও কোনও কথাই শুনলো না।
বললো ~ আমাকে আটকানোর চেষ্টা কোরো না। আমি তোমার বিয়ে করা বৌ নয়। আর ভুলে যেও না, এই ফ্ল্যাট তুমি আমার নামে লিখে দিয়েছো। তাই তুমি খুব শিঘ্রই এখান থেকে চলে যাবে। তোমার সাথে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখতে চাই না।

নিজের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস একটা ট্রলি ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। একটা মেসে উঠলাম। বাইরে অনেক টাকা ধার হয়ে গেছে। প্রতি মাসের মাইনের টাকার বেশীটাই ধার মেটাতে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আরও একটা
বছর এভাবেই কেটে গেলো। ধারের টাকা সব শোধ হোলো। মনে হলো এবারে বাড়ীতে বাবা মায়ের কাছে ফিরবো। বাবা কে ফোন করার সাহস পেলাম না। মা কেও ফোন করতে সংকোচ হচ্ছিল। মনে সাহস সঞ্চয় করে প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে মাকে ফোন করলাম। কতো দিন পরে মায়ের গলা শুনে মনটা শান্ত হোলো। কিন্তু মায়ের গলাটা এতো ঠাণ্ডা কেনো ? কথার মধ্যে কোনও তাপ উত্তাপ নেই কেনো ?

বললাম ~ মা তুমি ভালো আছো ? বাবা ভালো আছে তো ?

এবারে মায়ের গলায় উচ্ছাস যেনো উথলে উঠলো। বললো ~ হ্যাঁ রে খুব খুব ভালো আছি। আমাদের এই মেয়ে কি আর আমাদের খারাপ থাকতে দেবে। এতো ভালো মেয়ে সবসময় আমাদের খুব যত্নে রাখে।

বললাম ~ আমি খুব শিঘ্রই তোমাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি।

ফোন করার পর থেকেই মনে হচ্ছে মা কার কথা বললো। মেয়েটা আমার বাবা মাকে খুব যত্নে রাখে ?? কোন মেয়ের কথা বললো মা। মনে আশার আলো জ্বলে উঠলো। তবে কি তিন্নি, আমার তিন্নি ডিভোর্সের পরে এখনও আমাদের বাড়ীতেই আছে আমার অপেক্ষায়!!

কয়েকদিন পরেই বাড়ীর উদ্দেশ্যে ট্রেনে চেপে বসলাম। সারা সময়টা একই কথা মনে আনা গোনা করছে। মনে হচ্ছে কতক্ষণে বাড়ীতে পৌঁছে আমার তিন্নিকে আবার আগের মতো বুকে টেনে নেবো।আদরে ভরিয়ে দেবো। আমার সব ভুল তিন্নি ক্ষমা করে দেবে তো ? নিশ্চয়ই ক্ষমা করবে। আমি ওর দুটো হাত নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে ক্ষমা চেয়ে নেবো। তিন্নি এতো ভালো মেয়ে আমাকে ক্ষমা না করে পারবেই না।

পরের দিন যখন বাড়ীতে পৌঁছলাম তখন সকাল এগারোটা বাজে। ঘরে ঢুকে বাবা আর মা কে প্রণাম করলাম। কিছুক্ষণ মায়ের সাথে কথা বলার পরেই মনে মনে ব্যস্ত হচ্ছি তিন্নিকে আর আমার আদরের মেয়ে ফুলঝুরিকে দেখছি না। মাকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম আজ ফুলঝুরির জন্মদিন তাই ওকে নিয়ে তিন্নি মন্দিরে পুজো দিতে গেছে। নিজের ঘরে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিন্নি ফিরে আমার ঘরে চা নিয়ে এলো। খুব স্বাভাবিক কথাবার্তা বললো। যেনো কিছু ই হয়নি। দুপুরে নিচের ডাইনিং হলের টেবিলে যখন খেতে গেলাম তখন টেবিলে বাবা মা তিন্নি আর ফুলঝুরি ছাড়াও এক ভদ্রলোক কে দেখলাম।

অবাক হয়ে তাকাতে তিন্নি মুখে হাসি নিয়ে আমাকে বললো ~ সুদীপ তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।ইনি আমার স্বামী। ফুলঝুরির বাবা।

মা বললো ~ হ্যাঁ রে সুদীপ এ হলো জয়। নামেও জয় কাজেও জয়। তিন্নির সাথে একসাথে অফিসে কাজ করে। তুই দিল্লী থেকে যখন টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলি তখন সংসার চালানোর জন্যে তিন্নি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জয়েন করলো। তারপরেই জয়ের সাথে ওর বন্ধুত্ব হোলো। আমিই জোর করে ওদের বিয়ে দিয়েছি। ওদের নিয়ে আমরা খুব শান্তিতে আছি রে । তুই একেবারেই আমাদের নিয়ে চিন্তা করিস না। নিজের খেয়াল রাখিস ভালো থাকিস।

আমার চোখটা জ্বালা করে উঠলো। খেতে শুরু করলাম। ফুলঝুরি কে তিন্নি পায়েস খাইয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ ফুলঝুরি বললো ~ বাবা আজ আমার জন্মদিনে আমাকে পায়েস খাইয়ে দাও। ও বাবা।

মেয়ের ডাকে খেতে খেতে উঠে পরলাম। মেয়ে যখন চাইছে তখন আমি অবশ্যই মেয়েকে পায়েস খাওয়াবো। ফুলঝুরির কাছে যেতে গিয়ে থমকে গেলাম। দেখি জয় হাতে চামচে নিয়ে ফুলঝুরির মুখে পায়েস তুলে দিচ্ছে আর ফুলঝুরি হাসি হাসি মুখে ওর বাবার গলা ধরে বাবার গালে হামি দিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখার পরে আর গলা দিয়ে খাবার নামলো না। হাত ধুয়ে ওপরে নিজের ঘরে চলে এলাম। আজ আমারই ভুলে আমার স্ত্রী আমার আদরের মেয়ে জয়ের জীবন আলোকিত করছে। আমি সেখানে ব্রাত্য। বিকেলে নিজের ব্যাগ নিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলাম।

সৌজন্যে – প্রতিলিপি

Related News

Also Read