মনিশংকর চক্রবর্তী:-কাল টুনাবাবু আসছে। খবর দিয়েছে ছোট মুন্সি। ধনুর মা ভয়ে কাঁটা খবরটা পাওয়া ইস্তক। সে যদি একটু ডগর ডাগর হত ! নিজেকে বাবুর হাতে সঁপে দিয়ে মেয়েটাকে বাঁচানো যেত। তার এই চামড়া সর্বস্ব হাড়গিলে শরীর, বাবুর নজরের আওতায় ধরে না। বছরে দু বছরে একটা করে বিইয়ে পাঁচ ছেলেপুলের মা সে। গা গতর আর থাকে ? তাতেও রসোই মুন্ডার প্রতিদিন রাতে শরীর চাই। রসকসহীন এই শরীরে কি পায় কে জানে! গলাভর্তি মদ গিললে তার শরীরের খিদে তুঙ্গে ওঠে। জোর জবরদস্তি পুঁতে দেয় বীজ, ধনুর মায়ের পেটে।
এদিকে চোদ্দ বছরেই ধনু বেশ ডাগর। কবে না তার দিকে নজর লাগে টুনাবাবুর। দুখান ইঁটের উপর উবু হয়ে বসে ছোট কড়াইয়ে কাঠের জ্বালে সন্ধ্যেবেলা সে যখন পকোড়া ভাজে, তার আধখানা দাবনা আগুনের আলোয় চক্ চক্ করে। খাদান থেকে রেলের সাইডিঙ পর্যন্ত্য কয়লা বওয়ার কনভেয়ার বেল্ট বসানোর কাজে আসা বিহারী মজুররা রইয়ে সইয়ে ধনিয়া পাতার চাট দিয়ে পাঁচটাকার পকোড়া খেতে খেতে ধনুর দাবনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। তার কালো দাবনা থেকে ছিটকে আসা আগুনে মজুরেরা পুড়ে মোমের মত গলতে থাকে। দিনের পর দিন অভুক্ত শরীরের চড়া পড়া খিদে চাগাড় দিয়ে ওঠে উপোসি বাঘের মত।
আগুনের তাপ বেশি হলে বাঁ হাত দিয়ে উনুনের মুখ থেকে জলন্ত কাঠ বাইরে বের করে দেয় ধনু। সেই আলোতে স্পষ্ট, কয়েকজোড়া সাদা চোখের অপলক লোলুপ দৃষ্টি যেন ধনুর সম্পূর্ণ আঢাকা দেহকে শালপাতায় ধনিয়া পাতার চাটনির মত আগাপাশতলা চেটেপুটে খেতে চায়।
ধনুর মা সব বুঝতে পারে। দাবনা থেকে গড়িয়ে পড়া জামাটা মাঝেমধ্যে তুলে ঢেকে দেয়। মেয়েটার জন্যে একটা কামিজ কেনার ইচ্ছা, টুনাবাবু যদি টাকা দেয়। এতগুলো লোকের কূনজর থেকে মেয়েটা বাঁচে অন্তত তাহলে।
রসোই মুন্ডার আজ সময়ের ফুরসত নেই। মাসে, দুমাসে টুনাবাবু শহর ছেড়ে এই পান্ডব বর্জিত কয়লা খাদানে আসে। তার বেশ কয়েকটা ট্রাক চলে খাদান থেকে সাইডিঙ পর্যন্ত কয়লা বওয়ার কাজে। সেইসঙ্গে তার দুটো লোডারও গোঁ গাঁ ট্যাঁক ট্যাঁক আওয়াজ তুলে ট্রাকের ফেলে যাওয়া কয়লা নিমেষে ওয়াগনে ভরে দেয়। সেইসব কাজ দেখাশোনা করতেই তার আসা তা নয়, চব্বিশ ঘন্টা এসব কাজ দেখাশোনার জন্যে ছোট মুন্সি আছে।
শহুরে বেবুশ্যদের পাঁচভোগী শরীরের সোয়াদ পাল্টে একঘেয়েমি কাটাতে নিত্যনতুন আদিবাসী যুবতীদের টাটকা শরীরের রসোস্বাদন করাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। সে এলে রসোই মুন্ডার ঘরের কিছুটা ব্যবধানে খুপরি ঘরটায় ঘন্টাদুয়েক থাকে। টুনাবাবুর আসার খবর পেলেই রসোই ধনুর মাকে দিয়ে ঘরটা পরিষ্কার তকতকে করিয়ে রাখে। একটা চাদর পেতে দেয় মেঝেতে। চারটে কাচের গেলাস ভালো করে ধুয়ে রাখে। বিলিতি মদের বোতলটা বাবু সঙ্গে করে নিয়ে আসে। শুধু মুরগির কষাটা সে ভালো করে নিজে হাতে কষায়। দুপুর বেলা ছোট মুন্সির কাছ থেকে খবরটা পেতেই বিলিতি মদ আর মাংসের স্বাদ আস্বাদনের স্বপ্নে তার নোলা দিয়ে হুড়হুড় করে জল গড়িয়ে পড়ে।
গোবর গোলা দিয়ে ঘরটা ভালো করে ন্যেতিয়ে বাইরে এসে হাতটা ধুয়ে কাপড়ে মুছতে মুছতে ধনুর মা বলল, “বাবুর কাছে শ খানেক বেশি মাগিস।”
খুপরির সামনের মহুয়ার ফল পেকেছে। ঠপ্ ঠপ্ করে উঠোনে পড়ছে। রসোই উবু হয়ে ফলগুলো পেতেয় তুলছিল। কেজিতে দশ টাকা। কিলোদুয়েক হলে তার দু বেলার দুবাটি হাড়িয়ার খরচটা উঠে যায়। ফল তোলা থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ধনুর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেনে ? কি করবি ?”
ধনুর মা আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে বলল, “দরকার আছে রে, মেয়েটা বড় হইছে। একটা কামিজ লিতে হবেক।”
রসোই এর মাথা কদিন ধরেই গরম, যেদিন থেকে ধনুর মা বমি করছে। আবার বুঝি পেট বাঁধালো মাগিটা !
-কামিজ কি হবেক শুনি ? দাবনা ঢাকতে ?
মুখটা নিচু করে কাপড়ের ছেঁড়াফাটা আঁচলটায় ধনুর মা একমনে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “হঁ।”
-কটা মাগি কামিজ পরে শুনি এখানে ? বাবু যা দু পাঁচশো দেয় তাতে তো চলে না, শেষকালে চাইতে গেলে সেটাও না বন্ধ হয়ে যায়। তার উপর তুই আবার বছর বছর পেট বাধাচ্ছিস।
ধনুর মায়ের গা গুলাচ্ছে। যেন পেট বাধানোর দায়টা তার ? শুকনো বমিটা পেট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। দুয়ারের খুঁটিটা দু হাতে টিপে ধরে কোনক্রমে ঢোঁক গিলে কণ্ঠনালি চেপে তাকে আটকে রেখেছে।
সব কটা মহুয়া তুলে নিয়ে পেতেটা দুয়ারের এক কোনে রেখে দিতে দিতে রসোই ধনুর মায়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, “রক্ত মোছার ন্যাতা জোটেনা আবার কামিজ পরবেক?”
রসোই বেরিয়ে যেতে ধনুর মা খুঁটিটা ধরে বসে পড়ে ওয়াক্ ওয়াক্ করতে লাগল। মুখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা টক্ লালা ছাড়া আর কিছু বেরুলো না।
টুনাবাবু এলে আর একজনের কাজ বাড়ে, নাউরু মুর্মু। বাবু এলে তার হাতে নিত্যনতুন উঠতি মেয়েছেলে সরবরাহ করাই তার কাজ। অবশ্য এজন্য তাকে যে খুব খাটতে হয়, তা নয়। এখানে দেশি মদ আর মেয়েমানুষ সহজলভ্য। ক্ষুধার্ত কুকুরের মুখে একটুকরো রুটি নাচানোর মত শুধু একটু লোভ দেখালেই সে সুড়সুড় করে নাউরুর খাঁচায় ঢোকে। তারপর তাকে বন্দী করে টুনাবাবুর সামনে ছেড়ে দেয়া। বাকিটা টুনাবাবু বুঝবে। সে এখানকার স্বঘোষিত নেতা একপ্রকার। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার দুঃসাহস কারোর নেই। বাবু চলে গেলেই পরের শিকার সে স্থির করে নেয়। তারপর ধীরে সুস্থে তাকে পটিয়ে বাবুর হাতে তুলে দেয়। এজন্য বাবুর কোন কার্পণ্য নেই। দু হাজার টাকার একটা কড়কড়ে নোট নাউরুর দিকে ছুঁড়ে দেয়। সেখান থেকে শ দুয়েক শিকারের হাতে গুঁজে দিয়ে বাকিটা নিজের পকেটে ভরে।
ধনুর দিকে তার নজর পড়েছে।
তার পুরুষ্টু দাবনা আর ডাঁসা পেয়ারার মত বুক পেলে টুনাবাবু খুব খুশি হবে, চাইকি তার বকশিশটা এক ধাক্কায় দুগুণ হয়ে যেতে পারে। বিহারী মজুরেরা সামনে রাখা মাটির কলসীতে মগ ঢুকিয়ে ঢক্ ঢক্ করে একপেট ঠান্ডা জল খেয়ে দলবেঁধে ভোজপুরি ভাষায় হল্লা করতে করতে বেরিয়ে যেতেই নাউরু ধনুর পাশে এসে উবু হয়ে বসল। বিক্রিবাটা আর হবে না, এটাই শেষ খোলা। উনুন থেকে জলন্ত কাঠটা বের করে শেষ খোলার পকোড়াটা ছানচা দিয়ে উল্টেপাল্টে ভাজতে লাগল। নাউরু উনুনের পাশে শালপাতায় রাখা কয়েকটা ভাজা পকোড়ার টুকরো মুখে ছুঁড়ে বলল, “তুই দিনমানে কি সুন্দর হচ্ছিস রে ধনু।”
ধনু মুখ ঘুরিয়ে ভিতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা খুশি চাপার চেষ্টা করল।
-একটু সাজুগুজু করলে তুকে আরো কত ভালো লাগবেক। সাজ না কেনে। তুই সাজলে বুধনী কুথায় লাগে !
ধনু আবার নিজের কাঁধে মুখ লুকায়। মাথায় ফুল গোঁজা ছাড়া তার আর কী সাজ আছে? তবে টিকরিপাড়ার বুধনি কি সাজন সাজে! গলায় রুপোর হার, কানে ঝুমকো, হাতে গোছা গোছা কাচের চুড়ি ! লাল শালোয়ার কামিজে ওড়নাটা হাঁটুতে দোল খায়। সামনের রাস্তা দিয়ে সাঁঝবেলায় ওড়না উড়িয়ে কোথায় যায়, কে জানে। ধনু বেসন গোলা থামিয়ে হাঁ করে চেয়ে থাকে ওরপানে। পকোড়াগুলো ছেঁকে শালপাতায় রেখে কড়াইটা পাশে নামিয়ে রাখল।
বড় টিনের বাক্সটায় দোকানের বাকি মালপত্র ভরে তালা মেরে, তেলটা ঠান্ডা হলে থালাটায় ঢেকে একটু দূরেই বাড়ি নিয়ে যাবে।
নাউরু তার পাশে দাঁড়িয়ে একটু ফিসফিসে বলল, “সাজবি তুই বুধনির মত? কানের দুল, নথ, হার, গোছা গোছা চুড়ি ? লাল শালোয়ার কামিজে তুকে মানাবে ভালো।”
সাজতে তো খুব ইচ্ছা করে কিন্তু কিছুই তো নেই তার। দড়িতে ঝোলানো গুটখা খৈনির প্যাকেটগুলো মুড়তে গিয়ে সেও যেন লাজে মুড়ে যেতে লাগল।
কয়লা খাদানের উঁচু টাওয়ার লাইটের চুঁয়ে পড়া আলোয় ধনুর লাজে মুড়ে যাওয়া মুখটা যেন রাঙা হয়ে উঠল।
নাউরু ধনুর একদম গা ঘেঁষে তার কানের কাছে প্রায় মুখ ঠেকিয়ে বলল, “কাল এরকম সাঁজবেলায় একজনকে খুশি করতে পারলে সব পাবি। আমি এসে নিয়ে যাব তুকে।”
বিকেলে শুকানো মহুয়া ফল ভাজা দিয়ে দুমুঠো ভাত মুখে তুলেছিল ধনুর মা। তারপর থেকেই বিছানায় শুয়ে আছে। শরীরটা বড্ড গুলোচ্ছে। বীজের আবরণ ফেটে অঙ্কুর উদ্গমের সময়টুকু এরকম হয়, তবে আজ যেন বড্ড বেশি। আজ রাতের রান্না করতে হবে না, ধনুর বাপ টুনাবাবুকে বিদেয় করে কষা মাংস আর রুটি নিয়ে আসবে।
হাতে ধরা ছোট্ট আয়নাটায় ধনু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখতে লাগল। কুপির টিমটিমে আলোয় তার কানে দুল, নাকে নথ, গলায় হার, হাতে কাচের চুড়ি ঝিলিক মারতে লাগল যেন। লাল শালোয়ার কামিজে বুধনির থেকেও কি সুন্দর লাগছে তাকে ? কয়েকটা মহুয়া ফুল বিকেলেই সে জোগাড় করে রেখেছে। মাথার চুলে গুঁজে সে অপেক্ষা করছে নাউরুদার জন্য। সে এলে তাকে নিয়ে যাবে কাকে যেন খুশি করার জন্যে।
ধনুর মা বলল, “ধনু, দোকান খুলবি নে ?”
ধনু বলল, “না, হোলিতে আজ বিহারীরা কাজে ছুটি নিয়েছে।”
তার কাচের চুড়ির ঝিনঝিন শব্দে ধনুর মা পাশ ফিরে ধনুর দিকে অপলক নির্বাক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। নিজের মেয়েকেই যেন চিনতে পারছে না সে। একি অপরূপ সাজে সজ্জিত তার ধনু! এক ভয়ংকর আশংকায় তার কেঁপে উঠল বুক।
জড়ানো গলায় সে বলল, “কোথা পেলি এসব ?”
ওড়নাটা কাঁধ থেকে হাঁটু পর্যন্ত টেনে ধনু দেখে নিল ঠিক বুধনির মত লাগছে কিনা।
ধনুর মা বিছানা থেকে শরীরটা আধতুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ফেলে দে এসব, দরকার নেই কামিজের। দরকার নেই দুল নথ চুড়ির।”
বাইরে সাইকেলের ঘন্টির আওয়াজ শুনে ধনু বেরিয়ে গেল। নাউরুদা তাকে নিতে এসেছে। কাকে যেন খুশি করতে হবে। সে তার রূপ দেখে নিশ্চয় খুশি হবে। আর সে খুশি হলে সব পাওয়া যাবে।
বমিটা পেট থেকে গলায় এসে আটকে আছে সেই বিকেল থেকে। যাহোক করে আটকে রেখেছে। শরীরটাকে ঘষটে তক্তার কিনারায় নিয়ে এসে হাতদুটো শক্ত করে তক্তার কোনায় ধরে মাথাটা ঝুঁকিয়ে হদ্ হদ্ করে বমি করতে লাগল ধনুর মা। বীজের আবরন ফেটে অঙ্কুরোদ্গম শুরু হল বোধহয়। শরীরটা হালকা লাগছে। চোখ জুড়ে আসছে ঘুমে।