তাপসী বিশ্বাস :- মধুপর্ণার মেজাজটা সকালে উঠেই বিগড়ে গেলো।
শাশুড়ী হেমলতার চিৎকারে ঘুম ভাঙলো।
” দেখো কান্ড! গেটের সামনে কারা যেন কার্তিক ঠাকুর ফেলে গেছে।কি আক্কেল রে বাবা।এবার কে এই হ্যাপা সামলাবে? “
মধুপর্ণার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর।ছেলে মেয়ে এখনো কেন যে হলো না — এই নিয়ে পাড়া পড়শী, আত্মীয় স্বজন দের ঘুম নেই। বাড়ি বয়ে এসে একথা সে কথার পর বয়স্করা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে,
” আর কত দিন মুক্ত পক্ষ বিহঙ্গ হয়ে থাকবে?এবার আমরা দিদা ঠাম্মা হই!তোমার শাশুড়ীর এখনো বয়স আছে,মানুষ করে দেবে।”
প্রথম প্রথম একটু লজ্জা পেলেও এখন মধুপর্ণার অসম্ভব বিরক্ত লাগে,রাগ হয়।
তার ব্যক্তিগত জীবনে মানুষদের নাক গলানোর শেষ নেই।নির্ঝরকে তো কেউ কিছু বলে না! তাকেই যত কথা শুনতে হয়। মধুপর্ণার মনে হয় সে যেন পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি।
এখন আর আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে না।বিয়ে বাড়ি,অন্নপ্রাশন বাড়ি এড়িয়ে চলে।
পরিচিত কারোর ছেলে মেয়ে হলে শাশুড়ী সাত কাহন শুনিয়ে যায়।
মধুপর্ণার মনে হয় এ বাড়িতে সে যেন জোর করে থাকছে।সংসারে নতুন অতিথিকে না আনতে পারার দায় যেন একা তার। এক একসময় মনে হয় সে যেন সংসারে অনভিপ্রেত। এক ছাদের নীচে থাকলেও যোজন পরিমাণ দূরত্ব শাশুড়ী মায়ের সাথে।এ বড় অসম্মানের থাকা।নির্ঝরকে বলে কোন সুরাহা হয় না।এক কথা,” মা’র কথা গায়ে মেখো না।’
নির্ঝর তিন তিন বার জয়েন্ট দিয়েও মেডিকেলে চান্স পায় নি।জেনারেল লাইনেই পড়াশোনা করেছে।কৈ, ওকে তো কেউ বলে না, ” তুমি পারো নি,তুমি পারো নি,তুমি হেরো,তুমি হেরো ।”
সামনা-সামনি না বললেও আকারে ইঙ্গিতে শাশুড়ী, শ্বশুর মশাই বুঝিয়ে দেন,” তুমি আমাদের খুব ফাঁকি দিয়েছো।এখনো বংশধর দিতে পারো নি আমাদের।তোমার বাজার দর অর্ধেক হয়ে গেছে।”
সব কিছুরই অলিখিত বাজার দর আছে।সম্পর্ক গুলিও শর্তাধীন। শুধু মা, বাবা এর বাইরে।
শ্বশুর মশাই হেমলতাকে বললেন,” তুলে নাও ঘরে ঠাকুরটাকে। কি লাগবে বলো,নিয়ে আসি বাজার থেকে।”
” আমি পারবো না। তোমার সখ হলে যাও,কোলে তুলে নিয়ে এসো।আমি এর মধ্যে নেই। কাজের কাজ কিছু নেই,শুধু খরচের বাহার।”
মধুপর্ণা ঘর থেকে সব শুনতে পাচ্ছে।
শাশুড়ী বকবক করতে করতে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন। ডাইনিং স্পেসে শ্বশুর মশাই খবরের কাগজ দিয়ে মুখ আড়াল করলেন।অস্বস্তিকর পরিবেশ।নির্ঝর গেছে অফিস ট্যুরে।আজ মধুপর্ণার স্কুলও ছুটি। না হলে এতোক্ষনে স্কুল যাবার প্রস্তুতি নিতো।
মধুপর্ণা এবার ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে গেলো ব্যাপারটা কি। সদর দরজার বাইরে গ্রীলের গেটের ভেতরে একটি এক ফুটের কার্তিক ঠাকুর বসে আছে। ভেতরে যাবার প্রবেশাধিকার পায় নি।মধুপর্ণা কোথায় যেন নিজের সাথে মিল পেলো।অন্দরে এবং অন্তরে ঢোকার ছাড়পত্র নেই কার্তিকের।
মধুপর্ণা কার্তিক ঠাকুরটিকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে গেলো।পড়ার টেবিলের ওপর রেখে দেখলো মন্দ লাগছে না। শাশুড়ী মায়ের বচনের তোয়াক্কা না করে কার্তিক টি ঘরে নিয়ে এসে ভারি ভালো লাগলো।কার্তিক ফেলা নামক গ্রাম্য প্রথাটিকে মধুপর্ণা দু চোখে দেখতে পারে না।আজ কিন্তু আত্মপ্রসাদে মনটা ভরে গেলো।
মধুপর্ণা আর বিরক্তিকর,ক্লান্তিকর চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে যাবে না। রোবট নাকি সে! এবার নিজের শর্তে বাঁচবে। বিয়ের পরে নাটকের দলের সাথে যোগাযোগ কমে এসেছিলো।
আজ শোভনদার সাথে দেখা করবে।ওরা নতুন নাটক কবে নামাবে জানতে হবে।
হঠাৎ মনটা আজ প্রসন্নতায় ভরে উঠলো।সে একটি মানুষী।এই পৃথিবীতে তার নিজের আনন্দে সে বাঁচবে।পরম আনন্দময় চেতনায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিব্যাপ্ত।
মধুপর্ণা তারই একটি অংশ। কাল একটি ছাত্রী জন্মদিন উপলক্ষে চকলেট দিয়েছিলো।মধুপর্ণা চকলেটটা কার্তিক ঠাকুরের সামনে রেখে বললো,” খাও”।আজই ব্রোকারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।একটা এক কামরার ফ্ল্যাট চাই।
সৌজন্যে – প্রতিলিপি