আত্মভোলা সুরসাধক ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। এক ঐশ্বরিক ক্ষমতায় তিনি শ্রোতাদের মন জয় করতে পারতেন। অনেকেই বলতেন ভীষ্মদেব শ্রোতাদের নাড়ি ধরতে জানতেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম কন্ঠশিল্পী ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার পাণ্ডুয়া স্টেশনের কাছে সরাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আশুতোষ চট্টোপাধ্যায় ও মাতা প্রভাবতী দেবী। তাদের পরিবার সাধক গঙ্গাধর স্বামীর বংশধর ও গদাধর চট্টোপাধ্যায় তথা শ্রীরামকৃষ্ণ -এর পরিবারের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে তার মধ্যেও আধ্যাত্মিক প্রবণতা লক্ষিত হয়েছে বারবার।
১৯২০ সালে মাত্র এগারো বছর বয়সে ভীষ্মদেব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর গান শুনে পুষ্পস্তবক দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। অন্য একটি অনুষ্ঠানে রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীও তাঁর গান শুনে আশীর্বাদ করেন। বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার সময়ে কলেজ প্রতিযোগিতায় খেয়াল, টপ্পা, ও ঠুমরি বিভাগে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং সেরা গায়কের পুরস্কার পান।
ভীষ্মদেবের একজন গুণমুগ্ধ ছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি নজরুলের ইচ্ছেতেই ১৯৩৩ সালে তিনি মেগাফোন কোম্পানির সঙ্গীত পরিচালক ও প্রশিক্ষকের পদে যোগ দেন। সেই বছরেই মেগাফোন কোম্পানি থেকে তাঁর গাওয়া দু’টি খেয়াল প্রকাশিত হয়। এর অল্প সময়ের মধ্যেই ইলাহাবাদ, দিল্লি, লখনউ, বেনারস, কানপুরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ভীষ্মদেব আমন্ত্রণ পেতে থাকেন।
১৯৩৬ সালে মেগাফোন কোম্পানির কর্ণধার জে এন ঘোষ এবং কবি অজয় ভট্টাচার্যের অনুরোধে ভীষ্মদেব বাংলা গান রেকর্ড করতে রাজি হয়েছিলেন।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ভীষ্মদেব ফিল্ম কর্পোরেশনে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে যোগদান করেন। তিনি ছয়টি বাংলা ও ছয়টি হিন্দি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এগুলির চারটিতে শচীন দেব বর্মণ তার সহকারী হিসাবে কাজ করেন।এই সিরিজের প্রথম ছায়াছবি ছিল সুশীল মজুমদারের পরিচালনায় ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি রিক্তা । ভারতীয় ছায়াছবিতে এই প্রথম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অপূর্ব মিশ্রণে চলচ্চিত্র জগতে মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
সঙ্গীতাচার্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলকাতার বি টি রোড ক্যাম্পাসে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কণ্ঠসঙ্গীত বিভাগে তৈরি হয়েছে এক সংগ্রহশালা। সেখানে কিংবদন্তি এই শিল্পীর তানপুরা, হারমোনিয়াম, গানের সিডি-রেকর্ড, বিভিন্ন মেডেল, পদক, ব্যবহৃত জিনিসপত্র রয়েছে। রয়েছে তার উপর লিখিত বইপত্র, সুরোরোপিত ছবির ক্যাটালগও।
তাঁর শেষ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান কলামন্দিরে বদল খান সাহেবের স্মরণসভায়।১৯৭৭ সালের ৮ অগস্ট সন্ধেয় তাঁর অবস্থার অবনতি হয়।ঘড়িতে তখন রাত আটটা বেজে পাঁচ। নিভে গেল রাগসঙ্গীতের এক অম্লান শিখা।
ঐশ্বরিক এক ক্ষমতায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় শ্রোতাদের মন জয় করতেন। তাঁর সমৃদ্ধ গায়কিতে তানবিস্তার এমন দুর্বার গতিতে চলত যে, প্রতি মুহূর্তেই থাকত অপ্রত্যাশিত চমক।সরস্বতীর বরপুত্র এই সঙ্গীত সাধককে এখন সংবাদ পরিবারের শতকোটি প্রণাম

