Select Language

[gtranslate]
১২ই পৌষ, ১৪৩১ শুক্রবার ( ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ )

।। নিজের বাড়ি ।।

শম্পা শীল (দত্ত) :- বিয়ে হয়ে তিন মাস হলো ঝিমলি রায় পরিবারের বউ হয়ে এসেছে, এরই মধ্যে অবিনাশ (শশুর মশাই )কে মাঝে মধ্যেই বলতে শুনেছে “আমার বাড়িতে এসব চলবেনা”,যদি ও ঝিমলি কে বলেনি তার শাশুড়ী মা গৌরী কে বলেছে।

খুব ছোটো থেকেই ঝিমলি”আমার বাড়ি”কথাটার সাথে পরিচিত।ছোটবেলায় বাবা কে হারিয়ে ঠাকুমা,ঠাকুরদা,কাকা,কাকিদের মাঝেই ঝিমলি বড়ো হয়েছে,বাবা না থাকার জন্য মাকে অনেক অন্যায় কথা সহ্য করে নিতে হয়েছে।মায়ের সুন্দর গানের গলা থেকে ও সুর বন্ধ করে দিয়েছিল,তবু ও কিছু সমস্যা হলেই ঠাকুরদা কে বলতে শুনেছে “আমার বাড়িতে এসব চলবে না”_এখানে থাকতে গেলে আমার সিদ্ধান্তেই চলতে হবে।বাবা চলে যাবার পর মা কোনোদিন নিজের স্বাধীনতায় চলতে পারেনি_যখনই যা করেছে আম্মা দাদু এমন কি কাকু দের কাছে ও মতামত নিয়ে করতে হয়েছে।এমনকি নিজের মেয়ের সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে ও বাড়ীর সকলকে জিজ্ঞাসা করতে হতো।তারপর ও দাদুর মুখে
এসব কথা শুনে ঝিমলির মা শুভ্রা ঘরে বসে কাঁদতো,ঝিমলি কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুভ্রা বলতো_পড়াশুনা শিখে বড়ো হও,তখন এসব বুঝবে।ঝিমলির মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল তাকে পড়াশুনা শিখিয়ে চাকরি করতে দেবে,কিন্তু সেখানে ও ঠাকুরদা ও কাকারা মত দিলনা।তারফলে ভালো ছাত্রী থাকা সত্বেও মাস্টার ডিগ্রীটা শেষ করেই বিয়েতে বসে যেতে হয়েছিল ঝিমলিকে।

ঝিমলি শশুর বাড়িতে আসার পর থেকে দেখছে ওনার শাশুড়ী মায়ের মত ঠান্ডা মানুষ হয়না,মানুষ টা সারাদিন মুখ বুঝে বাড়িতে প্রতিটা লোকের সব কাজ করে যায় তবু ও দিনের শেষে কারোর মন পায়না।আর কিছু সমস্যা হলে তো শশুর মশাই এর একটাই কথা _”আমার বাড়িতে এসব চলবেনা”।

ঝিমলির মানুষটার জন্য খুব কষ্ট হতো,একদিন সে তার শাশুড়ী কে বলেই দিল”বাবা যে এরকম বলেন,তুমি কেনো কোনো প্রতিবাদ করোনা মা, এই বাড়িটা তো তোমার ও বাড়ি,তুমি কত যত্ন করে আদর ভালোবাসা দিয়ে বাড়ীর প্রতিটা লোকের খেয়াল রাখো,বাড়ীর সব মানুষ গুলো কে এক সুতোয় গেঁথে রাখো, তাও তোমায় কেনো এসব কথা শুনতে হবে”।

ঝিমলির কথা শুনে সেদিন গৌরী হেসে বলেছিল আমাদের এই শুনেই জীবন কেটে গেলো,আমি চাইনা তোকে কখোনো এসব কথা শুনতে হয়_তুই পড়াশুনা শিখেছিস,নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা কর,বাড়িতে বসে না থেকে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা কর।

তারপর থেকেই ঝিমলির মনে হলো নিজের পায়ে তাকে দাঁড়াতেই হবে নিজে রোজগার করতে হবে।তার নিজের মা শাশুড়ীরা যেসব কথা শুনে এসেছে ,এটা সে শুনতে পারবেনা।আর এই সব মানুষ গুলো কে বোঝাতে হবে ইট পাথর দিয়ে শুধু বাড়ি হয়না,বাড়ি কে বসবাস যোগ্য করার জন্য চাই আদর,যত্ন,ভালোবাসার। সেই প্রয়োজন টা মেটাতে পারে বাড়ীর মেয়েরা বউরা।

এরপর থেকেই ঝিমলি চাকরির চেষ্টা করতে লাগলো,কিছুদিনের মধ্যে একটা ভাল চাকরিও পেয়ে গেলো,স্বামী রুদ্র কে জানালে সে খুব একটা ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কিছুই প্রকাশ করলনা। শাশুড়ী শুনে খুবই খুশি হলো কিন্তু শশুর মশাই একদমই মত দিলনা,তার মতে এবাড়ীর বউরা চাকরি করবেনা। কিন্তু সে সব কথা না শুনে ঝিমলি শশুর মশাই এর মতের বিরুদ্ধে গিয়েই চাকরিটা শুরু করলো।
ঝিমলির চাকরি করার পর থেকেই বাড়িতে শশুর ও শাশুড়ী মধ্যে একটা চাপা অশান্তি শুরু হলো,যেটা ঝিমলি বুঝতে পারতো। এই ব্যাপারে ঝিমলি গৌরীর কাছে কিছু জানতে চাইলে,গৌরী বলতো তুই মন দিয়ে চাকরিটা কর এসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবেনা।

কিছুদিনের মধ্যেই ঝিমলির সামনে ব্যাপার টা পরিষ্কার হয়ে গেলো,একদিন রাতে রুদ্র ঝিমলি কে বললো”তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও,আমার বাবা চায়না ঘরের বউ চাকরি করুক”
ঝিমলি_তুমি কি চাও?
রুদ্র_আমি বাড়িতে অশান্তি চাইনা,তোমার চাকরি করা নিয়ে আমার মা বাবার জীবনে সমস্যা আসুক আমি চাইনা।

ঝিমলি_তুমি তাহলে চাও আমি চাকরি টা ছেড়ে দিই?
রুদ্র_হ্যাঁ
ঝিমলি_যদি চাকরিটা না ছাড়ি
রুদ্র_আমার বাড়িতে এসব চলবেনা।এখানে থাকতে হলে আমি যা বলব সেটাই মানতে হবে।

ঝিমলি কথা গুলো শুনে যেনো বোবা হয়ে গেলো,মনে মনে ভাবলো একই ঘটনা তার জীবনের সাথেও ঘটলো। সময় বদলালে ও চিন্তাধারা বদলায়নি।

পরেরদিন অফিস না গিয়ে ঘরেতেই বসে রইলো।সবাই যে যার কাজে বেরিয়ে যাবার পর গৌরী ঝিমলির কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো “কি হয়েছে?আজ অফিসে গেলিনা কেনো”?

ঝিমলি আগের দিনের রাতের সব কথা গৌরী কে বলে কেঁদে ফেললো।গৌরী ঝিমলির মাথায় হাত রেখে বলল এটুকু কথাতে চোখে জল এনে ফেললি,জীবনে আরো অনেক কথার সামনে আসতে হবে,তখন কি করবি?_এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লে চলবে কি করে?তোর লড়াই টা যে অনেক বড়ো,তোকে এই লড়াই টা চালিয়ে যেতে হবে।

ঝিমলির হাতে হাত রেখে গৌরী বললো লড়াই টা শুরু কর,আমি তোর পাশে আছি,কিন্তু লড়াই টা কি করে শুরু করবি এটা তোকে নিজেকেই ঠিক করতে হবে।

ঝিমলি সারাদিন ধরে অনেক ভেবে ঠিক করলো সে এই বাড়ি থেকে বাইরে গিয়ে চাকরিটা করবে_চাকরি করেই নিজের প্রাপ্য সম্মান আদায় করে নেবে।

পরেরদিন সকালে খাবার টেবিলে সকলের সামনে ঝিমলি গিয়ে জানাল সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে,তার নিজের যোগ্যতায় পাওয়া চাকরি সে ছাড়বেনা।ঝিমলির কথা গুলো শুনে সকলে চুপ হয়ে গেলো,গৌরী শুধু মনে মনে খুব আনন্দ পেলো।ঝিমলির চলে যাওয়ার কথাতে বাড়ীর অন্য কারোর মধ্যে কোনো হেলদোল দেখতে পেলনা।

ঝিমলি অফিসে গিয়ে মায়ের কাছে ফোন করে সব জানাল,শুভ্রা তো শুনেই ভয় পেয়ে গেল,তবুও ঝিমলি কে বুঝতে দিলনা,ঝিমলির মনে সাহস যোগালো আর বললো ,বাড়ীর বাইরে না বেরিয়ে বাড়িতে থেকে লড়াইটা এগিয়ে নিয়ে যাবার মত দিল।

কিন্তু ঝিমলি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে যোগ্য সন্মান না নিয়ে বাড়িতে ফিরবেনা।

ঝিমলি দুদিনের জন্য এক বন্ধুর বাড়িতে থেকে গেলো,তারপর ওখান থেকে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে সেখানে চলে গেলো।সেখানকার ঠিকানা জানাল শুধু মা আর শাশুড়ী কে।

ঝিমলি বাড়ি থেকে চলে আসার পর ও তার সাথে যে গৌরীর যোগাযোগ আছে এই ব্যাপারটা ঝিমলির শশুর মেনে নিতে পারেনি_কিন্তু এই প্রথমবার গৌরী তার স্বামীর বিপক্ষে গিয়ে জোর করেই ঝিমলির সাথে যোগাযোগ টা চালিয়ে যেতে লাগলো।

প্রতিদিন বিকাল বেলায় শাশুড়ী এসে রান্না করা খাবার দিয়ে যেতেন,মাঝে মাঝেই মা এসে দেখা করে যেত_এভাবেই কেটে গেলো ঝিমলির নূতন সংসারের কয়েকটা মাস।এরপর মা আর শাশুড়ী কে নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করলো।সে ফ্ল্যাট এর একটা ঘরে ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে একটা গানের স্কুল খুললো যার দায়িত্ব দিল মা কে_যার মধ্যে দিয়ে মা যাতে নূতন করে আবার বাঁচতে পারে,মা এর গলায় আবার নূতন করে সুর আসে।আর কিছুটা সময় রাখলো সেলাই এর কাজের জন্য যার দায়িত্ব দিল শাশুড়ী কে।

সবার অলক্ষে এভাবে কেটে গেলো আরো কিছু মাস,এরমধ্যে রুদ্র বার কয়েক ফোন করেছে ঝিমলি কে আসার জন্য কিন্তু শর্ত একটাই যাতে চাকরিটা সে ছেড়ে দেয়_যা ঝিমলির পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলনা।
দেখতে দেখতে আর বেশ কিছু মাস কেটে গেল,ততদিনে ঝিমলির চাকরিটা ও পাকাপাকি হয়ে গেলো।

ঝিমলি তখন সরকারী লোনের ব্যাবস্থা করে নিজেই একটা ফ্ল্যাট কেনার চিন্তা ভাবনা করলো। সেই সব ব্যাবস্থা করে ঝিমলি একটা দু কামরার ফ্ল্যাট কিনেও নিলো_ যা তার নিজের।

তারপর সেখানে পুজো করে গৃহপ্রবেশ করলো শাশুড়ী কে নিয়ে।গৌরীর কাছে ঝিমলি তখন মেয়ে,ঝিমলির স্বপ্ন পূরণ যেনো গৌরীর স্বপ্ন পূরণ।গৌরী ও বাড়ি থেকে কিছু দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ীর সকল কে জানিয়ে ঝিমলির কাছে এসে থাকলো।

গৌরী চলে আসতে ওই বাড়ীর প্রতিটা লোক যেনো অন্ধকারে ডুবে গেলো,একে একে প্রতিটা লোক যেনো বুঝতে পারলো গৌরী কত ছোটো ছোট জিনিসের ও খোঁজ খবর রাখত,শুধু টাকা রোজগার করা,রান্না করে খাওয়া এই গুলোয় জীবনের সব না,এর বাইরে ও অনেক ছোটো ছোটো চাওয়া পাওয়া থাকে যা পুরুষ মানুষের নজরে থাকেনা।

ঝিমলির শশুর যেন গৌরীর অনুপস্থিতিতে নিমেষে তখন নিজের ভুল গুলো কে বুঝতে পারলো।রুদ্র ও যেনো নিজের মায়ের অভাবে নূতন করে ঝিমলির অভাব টাও বুঝতে পারলো।

অবিনাশ আর রুদ্র দুজনেই নিজেদের ব্যাবহারে অনুতপ্ত হয়ে তারা ঝিমলির সাথে যোগাযোগ করে ঝিমলির বাড়িতে এলো, ঝিমলি আর তার শাশুড়ী গৌরী কে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।
ঝিমলি আর গৌরী কে শুধু ফিরিয়েই নিয়ে গেলোনা তাদের নিজেদের কাজকে সন্মান জানিয়েই তাদের নিজেদের সংসারে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো।

সমাজের সব মেয়েদের নিজেদের বাড়ি না থাকলে ও তারা তাদের কর্ম ক্ষমতায় ছোটো চাওয়া পাওয়া গুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে অন্যের বাড়িকে সুন্দর স্বপ্নের মত করে নিজের বাড়ি বানিয়ে তোলে যেখানে পুরুষ মানুষের সুখ শান্তি লুকিয়ে থাকে।


সৌজন্যে – প্রতিলিপি

Related News

Also Read